টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে মা ও ছেলেকে নির্যাতনের প্রতিবাদে এলাকাবাসীর বিক্ষোভ মিছিলে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার বিকেলে এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৫০ জন। এঁদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ বাদশাহ ও রুবেল নামে দুজনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
কালিহাতী বাসস্ট্যান্ডে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের সময় এলাকাবাসী কয়েকটি বাস ভাঙচুর করেন। এ সময় ওই মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর তাঁরা পুলিশের একটি মোটরসাইকেলও পুড়িয়ে দেন। বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ওই মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। এতে মহাসড়কের কয়েক কিলোমিটারজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানান, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত মঙ্গলবার কালিহাতীর সাতুটিয়া গ্রামে এক তরুণ ও তাঁর মাকে শ্লীলতাহানি ও নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ওই গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ওরফে রোমা ও তাঁর ভগ্নিপতি হাফিজুর রহমানের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এলাকাবাসী গতকাল বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। বিকেল চারটার দিকে তাঁরা কালিহাতী ও পাশের ঘাটাইল উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে কালিহাতী বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হতে থাকেন। বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁরা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ বাধা দেয়। তখন বিক্ষোভকারীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তাঁরা মিছিল করে থানার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ আবারও বাধা দেয়। এ সময় বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ প্রথমে বেশ কয়েকটি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। বিক্ষোভকারীরাও তখন পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। তখন উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। বিক্ষোভকারীরা বাসস্ট্যান্ডে কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে এবং গুলি ছোড়ে। পুলিশের লাঠির আঘাত ও গুলিতে অর্ধশতাধিক বিক্ষোভকারী আহত হন। আহত ব্যক্তিদের কালিহাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে গুরুতর আহত ব্যক্তিদের টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে কালিহাতীর কুষ্টিয়া গ্রামের ফারুক হোসেনকে (৩০) কালিহাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং ঘাটাইল উপজেলার সালেঙ্কা গ্রামের শামীম হোসেন (৩২) টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান বলে জানান কালিহাতী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন। তিনি বলেন, নিহত ফারুকের মাথায় এবং শামীমের পেটে গুলি বিদ্ধ হয়।
কালিহাতীতে মা ও ছেলেকে নির্যাতন
টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আশরাফ আলী সন্ধ্যা সাতটার দিকে জানান, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চারজনকে সেখানে নেওয়া হয়। এঁদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে বের করার সময়ই শামীম হোসেন মারা যান। বাকি তিনজনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
ঢাকায় নেওয়ার পথে রাত ১১টার দিকে মারা যান গুরুতর আহত তিনজনের একজন শ্যামল চন্দ্র দাশ। তাঁর বাড়ি ঘাটাইলের সালেঙ্কা গ্রামে, বাবার নাম রবি চন্দ্র দাশ। বাকি দুজনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
বিক্ষোভকারী এলাকাবাসীর ওপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছোড়ে বলে প্রথম আলোকে বলেন কালিহাতী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাহারুল ইসলাম তালুকদার।
এ ব্যাপারে কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলামের মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেনি। পরে সহকারী পুলিশ সুপার (গোপালপুর সার্কেল) জমির উদ্দিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কয়েকবার চেষ্টা করার পর রাত সাড়ে নয়টার দিকে তিনি ফোন ধরে জানান, জরুরি বৈঠকে আছেন। বৈঠক শেষে কথা বলবেন।
টাঙ্গাইলের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার (এসপি) সঞ্জয় সরকারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালিহাতীর ঘটনায় একজনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেন। তবে পুলিশের গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
উল্লেখ্য, কালিহাতী উপজেলার সাতুটিয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম ওরফে রোমার স্ত্রীর সঙ্গে পাশের ঘাটাইল উপজেলার আঠারদানা গ্রামের এক তরুণের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কয়েক মাস আগে ওই ছেলের সঙ্গে চলে যান রফিকুলের স্ত্রী। পরে পারিবারিক বৈঠকের মাধ্যমে স্ত্রীকে রফিকুলের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। গত সপ্তাহে রফিকুলের স্ত্রী আবার ওই তরুণের কাছে চলে যান। পরে গত মঙ্গলবার রফিকুল ওই তরুণ ও তার মাকে সাতুটিয়ায় ডেকে আনেন। এরপর বাড়ির উঠানে ওই তরুণকে বিবস্ত্র করে এবং তার মাকেও প্রায় বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় ছেলেটির মা বাদী হয়ে কালিহাতী থানায় মামলা করেন। পুলিশ রফিকুল ও তাঁর ভগ্নিপতি হাফিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।