নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল যে বাংলাদেশে সহসাই আসছে না তা আগেই নিশ্চিত ছিল। কিন্তু এই সফরটি বাতিল হচ্ছে নাকি স্থগিত তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের কোন ঘোষণা ছিল না। শেষ পর্যন্ত গতকাল সন্ধ্যায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এই সফর স্থগিত করে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এর আগে অবশ্য বিকাল ৫টার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি) একটি ই-মেইল প্রেরণ করে এবং সিরিজ স্থগিত হচ্ছে বলে জানানো হয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে সন্ধ্যা সাতটায় সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বিসিবি’র প্রতিক্রিয়া সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। মূলত ঘটনাটিকে দুঃখজনক ও বেদনার বলেই জানান তিনি। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার পরও এমন সিদ্ধান্তের কারণে আইসিসি’রও শরণাপন্ন হওয়ার কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন যে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এরই মধ্যে এই সফরটি স্থগিত করেছে। তারা আপাতত আসছে না। তবে আমি ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজন ও বেদনারই বলবো। কারণ আমি নিজেই বুঝতে পারছি না তাদের জন্য নিরাপত্তার এত ব্যবস্থা করার পরও কেন এলো না। পৃথিবীর প্রায় অনেক দেশেই এমন নিরাপত্তা সতর্কতা আছে। তাই বলে সেখানে ক্রিকেট বন্ধ হয়ে গেছে তা নয়। আমি আগামী ৯ই অক্টোবর আইসিসি’র একটি সভায় যোগ দিতে যাচ্ছি। সেখানেই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কথা বলবো এবং আইসিসিকেও জানাবো। আইসিসি’র কাছে জানতে চাইবো যে কি ধরনের নিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকলে একদেশের ক্রিকেটাররা অন্যদেশে যেতে পারবে।’ এমন ঘটনাকে বাংলাদেশের সম্মান ও ক্রিকেটের অপূরণীয় ক্ষতি বলেও উল্লেখ করেন নাজমুল হাসান।
২৮শে সেপ্টেম্বর দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। ৯ বছর পর এই টেস্ট সিরিজকে ঘিরে বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের ছিল ভীষণ উত্তেজনা ও আশা। কিন্তুদুইদিন আগে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ক্রিকেটারদের আসা স্থগিত করে। এরপরই অজি ক্রিকেট দলের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান শন ক্যারলের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। দুই দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দেশের সব ক‘টি গোয়েন্দা বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে কথা বলে তারা। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাদেরকে দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু ২৯শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গুলশানে আততায়ীর গুলিতে ইতালির এক নাগরিক নিহত হলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে যায়। সেদিন ভোর রাতেই বাংলাদেশ ছাড়ে অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা প্রতিনিধিরা। পরে গত দুইদিন কয়েক দফা আলোচনা শেষে এই সফর স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানায় তারা। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তার আশ্বাসের পরও তাদের এই সফরে না আসার বিষয়ে নাজমুল হাসান বলেন, ‘আসলে আমি এটাই অবাক হয়েছি। তাদের জন্য যে ধরনের নিরাপত্তার আয়োজন আমরা করেছিলাম তাতে আমি হলপ করে বলতে পারি ওদের ক্রিকেটারদের কোন ক্ষতি তো পরের বিষয়, এই সিরিজে ব্যাঘাত ঘটে এমন কিছুই হতো না। কিন্তু এরপরও তারা সিরিজটি স্থগিত করাতে আমরা অবাক হয়েছি। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস দেখেন সেখানে এমন কোন ঘটনাই ঘটেনি।’
তবে এই সফর বাংলাদেশে আবারও আয়োজন করা সম্ভব বলেই বিশ্বাস করেন নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন অত্যন্ত ভাল সময় যাচ্ছিল। কিন্তু এই সময় এমন একটি ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে আমি মনে করি এখনও সুযোগ আছে ওদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুতই এই ম্যাচ আয়োজন করবো। আমি ৯ তারিখ আইসিসি’র সভায় যাচ্ছি। সেখানেই ওদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করবো। আমি বিশ্বাস করি দ্রুতই এই সিরিজ আয়োজন সম্ভব হবে।’ সিরিজ আয়োজন হলেও এই ঘটনায় বাংলাদেশের ইমেজ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নিয়ে নাজমুল হাসান বলেন, ‘আমি মনে করি এই মুহূর্তে এই ধরনের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের অনেক বড় ক্ষতি হলো। এই দেশের ১৬ কোটি ক্রিকেট পাগল মানুষ কষ্ট পেয়েছে। আর দেশের ইমেজেও আঘাত লেগেছে।’
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বোর্ড সভাপতি বলেন, ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে সেই তালিকাতে আমাদের অবস্থা ২৩ নম্বরে। এমন কি অস্ট্রেলিয়া সরকার যে অ্যালার্ট জারি করেছে সেখানে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও শ্রীলঙ্কা ছিল। তাই বলে কি ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাতে খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি যে আইসিসিতে যাচ্ছি শুধু এই সফর কবে হবে তা নিয়েই কথা বলতে না। আমি আইসিসি’র কাছে জানতে চাইবো কি ধরনের নিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকলে এক দেশের ক্রিকেটাররা অন্যদেশে খেলতে যেতে পারবে।’
এই ঘটনার জন্য ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে এককভাবে দায়ী করেননি বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না এখানে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার খুব বেশি কিছু করার ছিল। এই সফর নিয়ে যখন একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় তখন আমি আইসিসি’র সভাপতি ও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারা যতটা জানি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি মনে করি এখানে অস্ট্রেলিয়া সরকারেরই চাপ ছিল। কিন্ত আমি জানি না আসলে কোন কারণে, কি এমন হয়ে গেছে যে বাংলাদেশে খেলতে আসা যাবে না।’ অস্ট্রেলিয়ার ফরেন অ্যাফেয়ারস বিভাগ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশে নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে বলে নিরাপদে চলাচলের নির্দেশ দেয়। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও একই অ্যালার্ট জারি করে বাংলাদেশে। কিন্তু কোন দেশের পক্ষ থেকেই জানানো হয়নি বাংলাদেশে কোন ধরনের নিরাপত্তা হুমকি আছে। এ বিষয়ে পাপন বলেন, ‘আমি যতটা জানি বাংলাদেশ সরকারও এই নিয়ে কাজ করবে। কারণ বাংলাদেশে কোন ধরনের জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসী হামলার সম্ভাবনা সেভাবে নেই। আর বাংলাদেশ সরকার বরঞ্চ গোটা বিশ্বে জঙ্গিবাদ নির্মূলের জন্য প্রশংসিত। কারণ এখানে এ পর্যন্ত জঙ্গিবাদ উত্থানের যে ঘটনা ঘটেছে তার সবই সরকার অত্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাই আমি নিজেও দেশের একজন সাধারণ নাগরিক ও পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে এ বিষয়ে কাজ করবো।’