দুই মাস আগের কথা। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। রাস্তায় অত্যধিক যানজট। সিএনজি চালিত অটোরিকশাটি দাঁড়িয়ে ছিল কাওরান বাজারে তিতাস ভবনের সামনে। গাড়িতে এক মহিলা যাত্রী বসা ছিলেন। কথা বলছিলেন মোবাইলে। এ সময় এক দুবর্ৃৃত্ত গাড়ির বাম্পারে উঠে ধারালে ব্লেডজাতীয় কিছু দিয়ে ছাদের পলিথিন কেটে ফেলে। এরপর ওই দুর্বৃত্ত যাত্রীর মোবাইলটি ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। তখন ওই মহিলাটি চিৎকার দেয়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির গ্রিলের দরজা খোলা হলে ওই দুর্বৃত্ত কোথায় হাওয়া হয়ে যায়। মহিলার ডান কানের এক কোণ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। কথাগুলো জানালেন ঢাকা মেট্রো-থ (১৩-০৩৯৭) অটোরিকশার চালক আসগার আলী। তিনি রামপুরার আলী হোসেনের গ্যারেজের ওই অটোরিকশাটি চালান। তিনি জানালেন, শুধু তার অটোরিকশা নয়, ঢাকার প্রায় সব অটোরিকশাই কখনো না কখনো এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তরা ব্যবহার করে ব্লেড। এই দুর্বৃত্তদের কাছে চালক ও যাত্রীরা অসহায় বলে তিনি জানান।
এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন এমন প্রায় ২০ জন চালকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। দুবর্ৃৃত্তরা ছাদ কেটে মোবাইল ফোন, হ্যান্ড ব্যাগ, স্বর্ণের চেইনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। ঢাকা মেট্রো-থ (১৪-৩৮৮৮) নম্বরের অটো রিকশার চালক আবদুল জব্বার, ঢাকা মেট্রো-থ (১৪-১৭২১) এর চালক রফিক উদ্দীন আহমেদ, ঢাকা মেট্রো-থ (১১-৫৯১৪) এর চালক আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা মেট্রো-থ (১৪-৩৪২১) এর স্বপন আহমেদ, ঢাকা মেট্রো-থ (১৩-১২১৭) এর চালক করিম হোসেন, ঢাকা মেট্রো-থ (১৪-০৫৫১) সোহেল আহমেদ, ঢাকা মেট্রো-থ (১২-৯৮৪৪) এর চালক আবদুল আজিজ, ঢাকা মেট্রো-থ (১৩-৩৯৮২) এর রিপন হোসেন, ঢাকা মেট্রো-থ (১৩-২৫৫০) এর চালক শাহাদাত হোসেন ও ঢাকা মেট্রো-থ (১২৯৩-৫৬) এর চালক রাজিব হোসেন জানিয়েছেন, তাদের অটোরিকশার যাত্রীরা দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েছেন।
পান্থপথের মোড়ের রাস্তায় কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা মেট্রো-থ (১৭-৩৭৩৬) নম্বরের অটো রিকশার চালক আরিফ হোসেন, ঢাকা মেট্রো-থ (১৪-১২২১) এর চালক আরমান আলী, ঢাকা মেট্রো-থ (১৩-৩৭২৩) এর দেলহাজ আলী, ঢাকা মেট্রো-থ (১৩-২৩৯২) এর চালক সাইফুল হোসেন, ঢাকা মেট্রো-থ (১২-৭৫৩৭) এর চালক আব্দুর রহমান তাদের গাড়ি গুলো ছাদ কাটা পার্টির চক্রের কবলে পড়েছে বলে জানিয়েছে। এ ছাড়াও রূপসী বাংলা ক্রসিংয়ে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা মেট্রো-থ (১৪-২৬৬৭) এর চালক আবদুর রকিব, ঢাকা মেট্রো-থ (১২-৭৬০৬) এর কাওসার হোসেন, ঢাকা মেট্রো-থ (১২-৬৮৩১) এর জাহিদ হোসেন, ঢাকা মেট্রো-থ (১৩-১২৩৫) এর চালক সাদিকুল ইসলাম ও ঢাকা মেট্রো-থ (১৩-০৩৫৫) এর চালক মো. রেজাউল ওই চক্রের কবলে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে ডিএমপির ডিবি (দক্ষিণ) গাড়ি চুরি, ছিনতাই ও প্রতিরোধ টিমের ইন্সপেক্টর হাবিল হোসেন মানবজমিনকে জানান, ছাদ কেটে চুরির ঘটনা ঘটে থাকে। তবে আমাদের কাছে এই অভিযোগগুলো কম আসে। ভিকটিমের অভিযোগ পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সরজমিনে দেখা গেছে, ঢাকার পান্থপথে সিএনজি (অটো রিকশা) গুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির চালকেরা যাত্রীদের ডাকাডাকি করছেন। অধিকাংশ গাড়ির ওপর নীল রংয়ের পলিথিন দিয়ে ঢাকা। প্রায় গাড়িরই ছাদ, গলা বরাবর অথবা পিট বরাবর সেলাই করানো। অথবা কোন কোন গাড়ির ডান বা বাম পাশ কাটা। কাটা পলিথিনগুলো সেলাই করা আছে অথবা বড় বিভিন্ন রংয়ের টেপ মারা আছে। আবার কোন কোন গাড়িতে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়া আছে। অথবা বিজ্ঞাপন দেয়ার হট লাইনের অনেক নম্বর দিয়ে ঢাকানো। সেলাই করা কাটা পলিথিনগুলোর অবস্থা দেখে মনে হবে পলিথিনের ওপর বিজ্ঞাপনের পলিথিন। কিন্তু, গাড়ির ভেতর দেখলে ওই কাটার স্থানে নীল রংয়ের পলিথিন চোখে পড়বে না। দেখা যাবে, বিজ্ঞাপনের পলিথিন। আর চারপাশে নীল রংয়ের পলিথিন। সাম্প্রতিক সময়ে ওই ছাদ কাটা পার্টির রাজধানীতে একাধিক চক্র গড়ে উঠেছে। কোন কোন সিএনজি চালকেরাও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ছাদ কাটা পার্টির সদস্যরা অধিকাংশই বয়সে কিশোর ও যুবক। রাজধানীর বাংলামটর, পান্থপথ, বিজয় সরণির মোড়, বনানী ক্রসিং, গুলশান লিংক রোড, পল্টন মোড়ে, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড, রাসেল স্কোয়ার, মিরপুর গোলচত্বর এলাকায় এরা ওত পেতে থাকে। ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টরা জানান, দিনের বেলায় কম হলেও সন্ধ্যার পর এ ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। সিএনজি চালকেরা জানান আগে অধিকাংশ সিএনজির গেট খোলা থাকতো। যানজটে আটকা পড়লে দুর্বৃত্তরা যাত্রীদের কাছ থেকে অথবা সিএনজিতে থাকা মালপত্র ছিনিয়ে নিয়ে চলে যেতো। এই চুরি ও ছিনতাইকে প্রতিরোধ করার জন্য সিএনজির দুদিকের দরজায় গ্রিল লাগানো হয়েছে। শুধু যাত্রীদের দুইপাশে নয় চালকের পাশেও গ্রিল দেয়া হয়েছে। পুরো সিএনজিটিতে পলিথিন দিয়ে মোড়ানো হয়ে থাকে। এরপরও দুর্বৃত্তরা সিএনজির ছাদ কেটে চুরি করছে। এমন ঘটনার শিকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইয়াসিন আলী জানান, তিনি ব্যক্তিগত কাজ করেন উত্তরা থেকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় যাচ্ছিলেন। দুপুরে তার বহনকারী সিএনজিটি বনানীর রেলক্রসিংয়ের জ্যামের কারণে দাঁড়িয়ে ছিল। ওই সময় মোবাইল ফোনে কথা বলছিলাম। তখন এক দুর্বৃত্ত ওই মাথার ছাদের ফুটো দিয়ে আমার মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর ওই সিএনজির গেট খুলে দেখি যে, ওই দুর্বৃত্ত দ্রুত কোথাও উধাও হয়ে যায়। তিনি আরও জানান, ওই ছাদের ফুটো তিনি দেখতে পাননি। পরে বাধ্য হয়ে ওই সিএনজিতে করেই গন্তব্যে পৌঁছাই।
পান্থপথের মোড়ে দেখা যায়, ঢাকা মেট্রো থ-(১৩-৫৫৫৮) নম্বরের গাড়ি গাড়ি চালক রাসেল হোসেন জানান, তিনি গেণ্ডারিয়ার ফরিদাবজারের সুমনের গ্যারেজের গাড়ি চালান। সিএনজির ছাদ কেটে যাত্রীর জিনিসপাতি ছিনিয়ে নেয়ার একটি চক্র গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে আবার কিছু অসৎ চালকও জড়িত আছে। দুর্বৃত্তদের সঙ্গে তাদের লিয়াঁজো আছে। তিনি আরও জানান, রাজধানীর কোন সিগনালে গাড়ি জ্যামে পড়লে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ওই চালকেরা তার গাড়ির অবস্থান দুর্বৃত্তদের জানিয়ে দেয়। তেজগাঁওয়ের বিজয় সরণির মোড়ে সিগনালে অপেক্ষারত ঢাকা মেট্রো (থ) ১৩-১০৬৫ নম্বরের গাড়ির চালক দুলাল হোসেন জানান, ছাদ কাটা পার্টির দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। তার এই গাড়িও ওই চক্রের কবলে পড়েছিল।