সব মৃত্যুই চিরতরে চলে যাওয়া নয়। বিশেষ করে কীর্তিমানদের মৃত্যু। এদের মৃত্যুতে শারীরিক প্রস্থান ঘটে কেবল। কিন্তু কর্ম তাদের মানুষের মনে বাঁচিয়ে রাখে অনন্তকাল। তেমনই এক কীর্তিমান কলিম শরাফী। রবীন্দ্র সংগীতের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী। পৃথিবীর সব বন্ধন ছিন্ন করে তিনি এখন না ফেরার দেশের বাসিন্দা। আজ এ গুণী মানুষটির পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১০ সালের এই দিনে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নেন। কলিম শরাফীর জন্ম ১৯২৪ সালের ৮ই মে বীরভূম জেলার খৈরাডিঁহি গ্রামে। পিতার নাম সৈয়দ সমী আহমদ শরাফী। সম্ভ্রান্ত পীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে শৈশবেই তার স্বাধীন জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হয়। ১৯৪৭ সালে তিনি শুভ গুহঠাকুরতা প্রতিষ্ঠিত শিক্ষায়তন ‘দক্ষিণী’তে রবীন্দ্রসংগীতের ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। এ প্রতিষ্ঠানের অন্য সংগীত শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন সুবিনয় রায়। তাদের কাছেই তিনি সংগীত শিক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি সেখানে শিক্ষকতাও করেছেন। ১৯৪৮ সালে কলিম শরাফী মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, মো. ইসরাইল প্রমুখের সঙ্গে মিলে ‘বহুরূপী’ নাট্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ‘বহুরূপী’র যাত্রাপথে ‘নবান্ন’, ‘পথিক’, ‘ছেঁড়াতার’, ‘রক্তকরবী’ ইত্যাদি নাটকের সফল মঞ্চায়ন এক একটি ইতিহাস হয়ে আছে। ১৯৪৯ সালে ফরিদপুরে গোপাল হালদার, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ও বিজন ভট্টাচার্যসহ সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন কলিম শরাফী। ১৯৫০ সালে তিনি খুব অর্থকষ্টে পড়ে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী আবদুল আহাদ ও কবি সিকানদার আবু জাফরের আহ্বানে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। তার বাবা এসেছিলেন ১৯৪০ সালেই। ঢাকা এসে তিনি বেতারে ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন এবং ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গণসংগীত গেয়ে, বিশেষত সুকান্তের ‘অবাক পৃথিবী’ গানটি গেয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের কুনজরে পড়েন এবং ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম যান এবং সেখানে গিয়ে গড়ে তোলেন ‘প্রান্তিক’ নাট্যদল। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় কার্জন হলের সাহিত্য সম্মেলনে ‘প্রান্তিক’ তার নেতৃত্বে নাটক ও নৃত্য-সংগীত নিয়ে অংশগ্রহণ করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৫৭ সালে পূর্ব বাংলায় নির্মিত ‘আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে তার প্রথম প্লে-ব্যাক। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার পর কলিম শরাফীর গান রেডিওতে সমপ্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এ নিষেধাজ্ঞা আর তুলে নেয়া হয়নি। ১৯৬০ সালে এসএম মাসুদ প্রযোজিত ‘সোনার কাজল’ ছায়াছবি পরিচালনা করেন তিনি। এ ছবিতে তিনি জহির রায়হানকে কো-ডিরেক্টর হিসেবে নিয়ে কাজ করেন। এ সময় তিনি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। তার সংগীত পরিচালনায় নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র ‘ভেনিস’ আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। ১৯৬৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর জাপানি কারিগরি সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম টেলিভিশন কেন্দ্র খোলা হয়, যার নাম এনইসি। এ কোম্পানি কলিম শরাফীকে তাদের কোম্পানির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত করে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় কলিম শরাফীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের চক্রান্ত চলতে থাকে। এ সময়ে পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে তাকে জাপানে প্রশিক্ষণে যাওয়া থেকে বিরত রাখা হয়। পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং অভিমান নিয়ে ১৯৬৭ সালে তিনি টেলিভিশনের প্রোগ্রাম ডিরেক্টরের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বৃটিশ কোম্পানি পরিচালিত রেকর্ডিং কোম্পানিতে (ই এম আই গ্রুপ অব কোম্পানিজ, যা পাকিস্তান গ্রামোফোন কোম্পানি হিসেবে পরিচিত ছিল) তিনি ‘ম্যানেজার ইস্ট পাকিস্তান’ হিসেবে যোগ দেন। পরে এ কোম্পানিতে তিনি জেনারেল ম্যানেজার এবং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি উদীচীর উপদেষ্টা ছিলেন ও পরে তিনি উদীচীর সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। পরে সে পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা পরিষদ-এর সম্মানিত উপদেষ্টা সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে (১লা বৈশাখ, ১৩৯০) তিনি ‘সংগীতভবন’ নামে একটি সংগীত শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সংগীতভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৮৬ সালে সংস্কৃতি অঙ্গনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কলিম শরাফী ‘একুশে পদক’-এ সম্মানিত হন। ১৯৮৮ সালে নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক অর্জন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি ‘বেতার টিভি শিল্পী সংসদ’-এর কার্যকরী পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলোশিপ অর্জন করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি কলকাতার রায়মঙ্গল থেকে ‘সত্যজিৎ রায়’ পদকে ভূষিত হন। ১৯৯৬ সালে রেডিও-টিভি’র স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৭ সালে তাকে বাংলাদেশ টেলিভিশন পরিচালনার জন্য গঠিত উপদেষ্টা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি তার সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক ছাড়াও ‘বেগম জেবুন্নেসা ও মাহবুব উল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার’ অর্জন করেন। ১৯৯৮ সালে গণসাহায্য সংস্থার সম্মাননা লাভ করেন। ২০০০ সালে মহান স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। একই বছর কলকাতার দক্ষিণী ‘শুভগুহ ঠাকুরতা’ পদক এবং শেলটেক সম্মাননা অর্জন করেন। ২০০২ সালে জনকণ্ঠ সম্মাননা অর্জন করেন। একই বছর কলকাতায় ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বাংলা সংগীত মেলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হন। ২০০৩ সালে বীরভূম জেলা পরিষদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত থেকে জয়দেব মেলা প্রাঙ্গণে বাউল মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করার জন্য আমন্ত্রিত হন। অসুস্থতার কারণে তার পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়নি। একই বছর বাংলাদেশ বৌদ্ধ একাডেমী (আনোমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর প্রকল্প) চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততার কথা স্মরণ করে বাংলাদেশ বৌদ্ধ একাডেমী তাকে বৌদ্ধ একাডেমী পুরস্কার ’০২-এ পুরস্কৃত করেন। তিনি বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান পদে সমাসীন ছিলেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের এক অনন্য জাদুকর। তার সেই ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ জাদুকরী কণ্ঠের গান মুগ্ধতা বিলাবে অনন্তকাল।