আমার কোনো বন্ধু আছে, অসম্ভব সুন্দর গান গায়। আমি মুগ্ধ শ্রোতা, যদিও নিজে এক শব্দও গাইতে পারি না। কোনো বন্ধু আছে পাঁচটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। আমি বাংলাতেও ঠিকমতো গুছিয়ে আলাপ করতে পারি না। আমার এক বন্ধু ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করে চিনিকলের মৌসুমী শ্রমিক। আমি তার দারিদ্র্যের ভাগ নিতে পারিনি। আবার আমারই এক বন্ধুর পরিবারের প্রাত্যহিক ব্যয় আমার মাসিক আয়ের চেয়েও বেশি। তাই বলে আমি ধনী হয়ে যাইনি। আমাদের বন্ধুরা একেকজন একেক রকম হই। সবার ভিন্নতা বন্ধুত্বকে সুন্দর করে। তাই বলে সবাই একরকম হওয়ার চেষ্টাও করি না। হয়েও যাই না। কোনো বন্ধু আছে খুব খরুচে। কেউ ভীষণ কিপটে। কেউ প্রাণখোলা আড্ডাবাজ, কেউ অন্তর্মূুখী। সবাই সবার মতো। বন্ধু আছে নানা গুণের। নানা চেহারার। নানা ধর্মের, নানা মতের। তারা তাদের মতো। আমি আমার মতো। তাদের কারো সংজ্ঞা দিয়েই আমাকে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। করা ঠিকও হবে না। তাদের ভালো গুনগুলোও যেমন একান্তই তাদের। খারাপ কোনো অভ্যাস থেকে থাকলেও সেটাও শুধুই তাদের। ওদের গুনে যেমন আমার ভাগ নেই। বদ-অভ্যাসেও আমার অংশ নেই। খুবই সহজ হিসাব। অথচ জানি এই সহজ হিসাবটাই কারো কারো মাথায় ঢোকে না। তারা মনে করেছে অভিজিৎ রায় ‘নাস্তিক’ এবং ‘মুক্তমনা’। খুবই দুঃখজনক হলো কিছু কিছু বাংলা শব্দের প্রায়োগিক অর্থ এখন অত্যন্ত নেতিবাচক হয়ে উঠেছে। একের পর এক হত্যা। হত্যা পরবর্তী সময়ে খুন হয়ে যাওয়া মানুষদের প্রতি কিছু বিশেষণের ব্যবহার। আর রাষ্ট্রযন্ত্রের অসহনীয় নিরবতা, রাজনীতিবিদদের বালখিল্য বক্তব্য ইঙ্গিত দিয়েছে এইসব বিশেষণধারীদের হত্যা করা জায়েজ। অদৃশ্য ঘাতকেরা, আর তাদের অস্পষ্ট সমর্থকেরা যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে এইসব শব্দের নেতিবাচকতা। দেশের খুব সাধারণ শ্রেণীর ছাপোষা মানুষের কাছে এখন নাস্তিক বা মুক্তমনা শব্দগুলোর ভিন্ন অর্থ। সহজে স্বীকার করি বা স্বীকার করতে কষ্ট হোক বাস্তবতা এটাই। একের পর এক খুন হয়ে যাচ্ছে মানুষ। খুনি থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রচার হচ্ছে খুন হয়েছে নাস্তিক, খুন হয়েছে মুক্তমনা। সাধারণ মানুষ ভাবছে, খুন হচ্ছে যারা তারা অন্যরকম। আমরা সেরকম নই, আমরা বিশ্বাসী, আমরা প্রশ্ন করি না। সুতরাং আমি বা আমার পরিবার নিরাপদ। যেকারণে সাধারণ মানুষ এখনও তুলনামূলক কম ভীত, কম সোচ্চার। কিন্তু সত্যি কি তাই? অন্তত দীপন ভাইকে খুনের পর, প্রশ্নটা তোলাই যায়? দীপন ভাই বিশ্বাসী মানুষ। শুধু কথায় বিশ্বাসী নয়, চর্চাতেও বিশ্বাসী। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর উপর বইও প্রকাশ করেছেন। তিনি বিশ্বাসের ভাইরাসও প্রকাশ করেছেন। সেই অর্থে বলতে পারি মুক্তমনা শব্দটি এখন যে সংজ্ঞা পেয়েছে দীপন ভাই সেই সংজ্ঞায়িত মুক্তমনা নন। বরং শুভ বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন একজন মানুষ, একজন প্রকাশক। যে কি-না রিদাত রিদিতার বাবা, জলি ভাবির স্বামী, কাশেম স্যার আর ফরিদা ম্যাডামের ছেলে, সূচিতা আপার ভাই, অনেক অনেক মানুষের প্রিয় বন্ধু এবং আমার মতো আরো অনেক তরুণের প্রথম বইয়ের প্রকাশক। সেই দীপন ভাই কেন খুন হলেন? খুনিরা ধরা পড়বে না, বিচার হবে না। আমরা কীভাবে যেন জেনে যাই, এবারও জেনে গেছি। তারপরও শুধু জানতে ইচ্ছে করে এই মৃদুভাষী, গোছানো, ভদ্র, শান্ত আপাদমস্তক নিপাট ভালো মানুষটাকে হত্যার কারণ কী? আবারো বলছি এর আগে একই কায়দায় যতগুলো খুন হয়েছে, সবগুলোর ক্ষেত্রে কিছু বিশেষণ দিয়ে হত্যা জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষ খুন হয়ে গেছে, আমাদের বুঝ দেয়া হয়েছে, মানুষটা অবিশ্বাসী ছিল, মানুষটা বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কে ছিল। যেন অবিশ্বাসী মানুষের, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কে থাকা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তারপরও এইসব ছাইপাশ পরিচিতি আমাদের মনে মৃত ব্যক্তির প্রতি অনুভূতি জাগাতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছে। এই সুযোগে মামলা চলে গেছে হিমঘরে। সফল হয়েছে খুনি এবং তাদের দোসররা। দীপন ভাইয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু এর কোনোটাই খাটছে না। এবার তাহলে সাধারণ মানুষকে বুঝ দেয়া হবে কীসে? মানুষের এবার বুঝে নিতে হবে, স্বঘোষিত অবিশ্বাসী না হলেও কিন্তু আপনি নিরাপদ নন। চাপাতির কোপ পড়তে এখন আর কোনো কারণের দরকার নেই। যেমন কোনো কারণ ছিলনা দীপন ভাইয়ের। এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছে একটাই উছিলা। ফয়সাল আরেফীন দীপন অভিজিৎ রায়ের বন্ধু। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্বিকার আচরণ, বিচারহীনতা খুনিদের উৎসাহিত করে। সেই উৎসাহে খুনির দল প্রমাণ করতে চাইছে অবিশ্বাসী বা মুক্তমনার বন্ধু হলেও তার মুক্তি নেই। কিন্তু কে বোঝাবে যে বন্ধু হলেই একজন আরেকজনের মতাদর্শ ধারণ করে, পালন করে তা নয়। বন্ধু যদি অন্য ধর্মের হয় তাহলে আমি অন্য ধর্মের হয়ে যাই না। বন্ধু যদি ভিন্ন মতাদর্শের হয় তাহলে আমিও সেই একই মতাদর্শের হতে পারি না। অভিজিৎ রায় দীপন ভাইয়ের স্কুলের বন্ধু, কলোনীর বন্ধু। উনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না। কিন্তু দীপন ভাইয়ের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। খুব ভালোমতো চিনি। তার বন্ধুদের একজন অর্থনীতির তাত্ত্বিক দিক খুব ভালো বিশ্লেষণ করেন। তাই বলে দীপন ভাইও তাত্ত্বিক অর্থনীতি বিশ্লেষক ছিলেন, বলতে পারি না। কেউ আছে বর্তমান সরকারের ঘোর সমর্থক। তাই বলে দীপন ভাইও কি তাই? দীপন ভাইয়ের বন্ধুদের কেউ শিক্ষক, কেউ পুলিশ, কেউ ডাক্তার, কেউ সাংবাদিক। দীপন ভাই কিন্তু তাদের কারো মতো নয়। কোনো বন্ধু খুব ভালো ব্যাঙ্কিং বোঝে। দীপন ভাই বুঝতেন প্রকাশনা। কোনো বন্ধু এলোমেলো, অনেক কথা বলেন। দীপন ভাই বলতেন গুছিয়ে, অল্প করে। বন্ধুদের সঙ্গে এত এত পার্থক্য থাকার পরও কেন এক বন্ধুর গায়ে ‘নাস্তিকের’ লেবেল লেগেছে বলে দীপন ভাইকেও একইভাবে চিহ্নিত করা হবে? ভিন্ন মতাদর্শের বন্ধুর বই প্রকাশের ‘অপরাধে’ কেন তাকে এই নিষ্ঠুর শাস্তি পেতে হবে? যে লোক ওষুধের ব্যবসা করে। সব রোগের ওষুধ সে বিক্রি করে। তার মানে কি সেও সেসব রোগে আক্রান্ত? ময়রা মিষ্টি বানায়, মিষ্টি বিক্রি করে জীবিকার তাগিদে। এই মিষ্টি কিন্তু তার খাবার না। সারাজীবন ধরে ইসলাম নিয়ে গবেষণা করে বা কোরআন শরীফ অনুবাদ করেই কিন্তু ভাই গিরিষ মুসলমান হয়ে যাননি। আমার এই সব যুক্তি খুব সহজ। এত সহজ বিষয় যাদের মস্তিষ্কে ঢুকে না। যারা এক বন্ধুর আদর্শে বা আদলে আরেক বন্ধুকে যাচাই করে, লেবেল লাগায় তাদের মূর্খতা দেখে করুনা হয়। একই সঙ্গে করুনা হয় ক্ষমতাধারীদের প্রতি। যারা খুন হয়ে যাওয়া মানুষের পরিবারের পাশে দাঁড়ায় না। যারা বিচারহীনতার সংস্কৃতি দীর্ঘায়িত করে। যারা দায়িত্বে থাকে কিন্তু দায় নেয় না। আরেক দলের জন্যও করুনা হয়, যারা কি-না দীপন ভাইয়ের ক্ষত বিক্ষত লাশের গায়ে তথাকথিত নাস্তিকতা বা মুক্তমনার লেবেল লাগানো যাচ্ছে না দেখে আক্রোশে ফেটে পড়ছে। এই নিষ্ফল করুনাধারায় ভাসতে ভাসতে শুধু অনুভব করছি, বুঝে না বুঝে আমরা অজস্র মত, অজস্র পথে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেছি। যার যার সীমানায় দৃশ্যমান দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমরা কেউ আর নিরাপদ নই। এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল এখন আমাদের প্রত্যেকের জন্য মৃত্যু উপত্যকা।