আজ তো আমার লজ্জা পাওয়ার দিন নয়; কাব্য লেখার দিন। মাশরাফি আর ইমরুল কায়েসকে নিয়ে কাব্য করার কথা ছিল। স্টেডিয়াম থেকে এই কাব্য মাথার ভেতর ভাজতে ভাজতেই বের হচ্ছিলাম। কী শিরোনাম দিলে ভালো হয়? অনুপ্রেরণার নাম মাশরাফি! কিংবা ক্রিকেট মরণ নয় -এমন কিছু! ব্যাপারটা শুরু করেছিলেন ইমরুল। কোনো একটা প্রশ্নের জবাবে পাশে বসে থাকা মাশরাফিকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে আমাদের বস। ওনাকে সামনে রেখেই বলছি। মাঠে নামার আগে উনি যা বলেছেন, তাতে আমার সব প্রেশার রিলিজ হয়ে গেছে। ওনার কয়েকটা কথা এই অল্প সময়ে ক্রিকেট নিয়ে আমার চিন্তাটা বদলে দিয়েছে।’ একটু ইনিয়ে বিনিয়ে জানতে চাইলাম, কথাগুলো কী ছিল। ইমরুল একটু সংকোচে পড়ে গেলেন। ফিস ফিস করে অনুমতি চাইলেন, ‘ভাই, বলব?’ মাশরাফি বিব্রত হওয়া হাসি হেসে অনুমতি দিলেন। ইমরুলের জবানিতে আমরা ঘটনাটা জানলাম। টিম বাস রওনা দিয়েছে মাঠের উদ্দেশ্যে। বাসের মধ্যে সবাই টুকটাক মজা করছেন; নিদেনপক্ষে পরষ্পরের সাথে আলাপ করছেন। কিন্তু নিজের আসনে চুপচাপ শক্ত হয়ে বসে আছেন ইমরুল কায়েস। মুখ জুড়ে তার নতুন করে পাওয়া সুযোগ কাজে লাগানোর দুশ্চিন্তা। হঠাৎ ব্যাপারটা খেয়াল করলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন কাছে। আলতো একটা ডাক দিয়ে বললেন, ‘এতো টেনশনের কী আছে? তুই রান না পেলে কী মরে যাবি! কোনো খেলাই জীবনের শেষ নয়। জাস্ট মজা কর, নিজের খেলাটা খেলে আয়।’ আহ! কী কাব্যিক, দার্শনিক একটা বিষয়! এমন বিষয় নিয়ে লিখলে সে লেখা তো ‘অটো-হিট’। লাইকের বন্যা বয়ে যাবে, কমেন্টের পর কমেন্টে ভরে উঠবে আমার ফেসবুক। কিছু ফলোয়ার বেড়ে যেতে পারে, দু-দশটা নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসবে! আমি তখন মোহগ্রস্থ, লালসাযুক্ত এক লোভী দানবের মতো মাথার মধ্যে লাইকমুখী একটা কাব্যের হেডিং ভাবছি। হঠাৎ সতীর্থ শাহান ডাক দিয়ে চটকাটা ভাঙালো, ‘দাদা, আসেন। এক শ’ বিশ টাকায় যাবে।’ সিএনজি। এই মাঝরাতে কোত্থেকে এক মিটারবিহীন সিএনজি জোগাড় করেছে শান। বিরক্ত লাগলো চিন্তার সুতোটা একটু ছিড়ে যাওয়ায়। সিএনজিতে বসেও আমরা এইসব আলাপই করছিলাম। মাশরাফির দর্শন, মাঠে ফিল্ডিং সাজানো এবং আগামীকাল সাকিবের অনুপস্থিতি নিয়ে আরেকটা কাব্য বানানোর চেষ্টা; টিস্যু জার্নালিজম। হঠাৎ মূর্খ সিএনজিওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনারা কী খেলা দেখতে গিছিলেন, স্যার?’ ‘হ্যাঁ’ -ব্যাটা বিরক্ত করছে। ‘বাংলাদেশ কী আগে ব্যাট করছিল? কত রান করল?’ কোনোক্রমে মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে উত্তর দিলাম। শালা তোর এত খবরে কাজ কী! একটু পর আবার বোলিংয়ের কথা জিজ্ঞেস করে। জিম্বাবুয়ে কত রান করল, কে বেশি উইকেট পেল এবং মাশরাফি কেমন বল করল; এইসব ফালতু আলাপ। মাশরাফির বোলিংয়ের বর্ণনা শুনে বলে, ‘মাশরাফি সুস্থ থাকলে ভালো। এমনিতে ক্রিকেটে তো ফিটনেস বেশি লাগে না। তয় ওর ফিট থাকা জরুরি।’ এক লহমায় আমার ঘোর কেটে গেলো, কাব্য একটু দূরে সরে গেল। অপগন্ড এক সিএনজি ড্রাইভার ‘ফিটনেস’ নিয়ে কথা বলছে! তাও আবার শুদ্ধ ভাষায়! একটু কৌতুহল হলো, ‘ক্রিকেট-ফুটবল কিছু খেলতেন নাকি?’ ‘নাহ।’ ‘তাহলে? এসব ফিটনেস জানলেন কী করে?’ ‘তেমন কিছু না। একসময় একটু অ্যাথলেটিকস করতাম; দৌড়াতাম।’ এবার একটু সোজা হয়ে বসলাম, ‘দৌড়াতেন মানে কী? কোন ইভেন্টে দৌড়াতেন।’ ‘মাঝারি পাল্লা। আট শ’ মিটার আর পনেরো শ’ মিটার।’ আমি কী একটা যেন গন্ধ পাচ্ছি, ‘ন্যাশনাল খেলেছেন?’ ‘হ্যাঁ।’ আরেকটু এগোনো দরকার, ‘আপনার সময়ের অ্যাথলেট কারা? মেসবাহ ওরা?’ ঘ্যাচ করে সিএনজিতে একটা ব্রেক কষলো ড্রাইভার-সামনে স্পিড ব্রেকার। পেছন ফিরে এবার সে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আপনি মেসবাহকে চেনেন কী করে!’ পরিচয় দিলাম, সাংবাদিক। আর কথা এগোয় না। কিছুতেই না। এবার যা প্রশ্ন করি, আমার অপগন্ড ড্রাইভার শুধু হ্যা-হু করে। বারবার আমি আর শাহান জিজ্ঞেস করি, ‘অ্যাথলেটিকস ছাড়লেন কেনো?’ না পেরে বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল, ‘হাটুর ইনজুরি।’ ‘লিগামেন্ট!’ ‘হ্যা।’ স্তব্দ হয়ে বসে রইলাম। শাহান খামারবাড়ি নেমে গেল। নিজেকে জোর করে নামটা জিজ্ঞেস করলাম। নামটা আমার খুব চেনা চেনা লাগছিল; মনে আসে না, মনে আসে না। হঠাৎ মনে হলো, ‘আপনি কী একবার ডাবল জিতেছিলেন?’ আর কোনো উত্তর পাই না। বাসার সামনে থেমে গেল সিএনজি। মাথা নিচু করে পকেট থেকে টাকা বের করলাম। টাকাটা হাতে নিয়ে আমার পাশে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো ছয় ফুটি লোকটা। আস্তে আস্তে বললো, ‘স্যার, একটা রিকোয়েস্ট। আমার নামটা কাউরে বইলেন না। খবরের কাগজে লিখেন না।’ ‘কেন!’ ‘বন্ধুরা সব পুলিশে, আনসারে, বিভিন্ন বাহিনীতে আছে তো। সিএনজি চালাই শুনলে দুই-তিন হাজার টাকা নিয়ে দেখা করবে হয়তো। আমি টাকা খারাপ কামাই না। এই টাকা নিয়ে সবাই আসবে হেল্প করতে। প্লিজ স্যার, আমারে ছেড়ে দেন।’ ছেড়ে দিলাম। সিএনজি ঘুরে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের একজন জাতীয় অ্যাথলেট, কোনো একটা জাতীয় অ্যাথলেটিকস মিটে ডাবল জয়ী একজন অ্যাথলেট সিএনজি রিকশা টেনে এগিয়ে যাচ্ছেন নতুন গন্তব্যে। আমি কোথাকার কোন এক অপদার্থ, হলুদ সাংবাদিক দাঁড়িয়ে আছি। মাথার ভেতর ঘুরছে দেবাশীষ চৌধুরীর কথা। বিসিবির চিকিৎসা কক্ষে একদিন এক দৌড়বিদের চিকিৎসা করাতে করাতে বলছিলেন, ‘দাদা, জীবন দেখতে চাইলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যান। খেলা আর খেলার জীবন দেখতে পাবেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় খেলার খেলোয়াড়রা কেমন অমানুষের জীবন যাপন করে, দেখে আসেন। খাবার কষ্ট, চিকিৎসার কষ্ট।’ আমি মাথা নিচু করে ছিলাম। দেবাশীষ দা বলে চলছিলেন, ‘দাদা, এটা বড় লজ্জার কথা।’ আজও আমি মাথা নিচু করে আছি। দেবাশীষদার কথা খুব কানে বাজছে-বড় লজ্জার কথা। এই লজ্জা কোথায় রাখি আমরা!