ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর জুড়েই আলোচনা এক বিশেষ ক্ষমতা আইন মামলা নিয়ে। কারণ বিশেষও আছে। সেখানকার ৪ কলেজ শিক্ষককে করা হয়েছে এ মামলার আসামি। যারা শুধু শিক্ষকই নন মুক্তিযোদ্ধের চেতনায়ও বিশ্বাসী। তাদের একজন বঙ্গবন্ধু প্রেমি। অসংখ্য কবিতা ও ছড়া রয়েছে তার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। তিনি মহাজোটভুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি আসনের সংসদ সদস্যের আপন চাচাতো ভাই। কিন্তু বিজয়নগর থানা পুলিশ আপাদমস্তক আওয়ামী লীগের এই সমর্থক শিক্ষককেই ফাসিয়েছে নাশকতার মামলায়। কলেজ টু বাড়ি এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে গভীররাতে ওই উপজেলার এক গ্রামে জামায়াত নেতার বাড়িতে নাশকতার লক্ষ্যে গোপন বৈঠকে মিলিত হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। ইসলামপুর কাজী শফিকুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ঐ শিক্ষকরা নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করে পুলিশ সুপারের কাছে এই মামলা থেকে নিষ্কৃতির আবেদন করেছেন। গত ১৬ই নভেম্বর বিজয়নগর থানায় আলোচিত এই মামলাটি (মামলা নং ২২, ধারা ১৯৭৪ইং সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬(২) দায়ের করা হয়। এসআই মো. জসিম উদ্দিন বাদী এই মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে ঐদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে পশ্চিম মেরাশানী গ্রামের আলী নেওয়াজ ওরফে ডা. আলী নেওয়াজ এর বাড়িতে জামায়াত ও বিএনপির কিছু সংখ্যক নেতাকর্মী সরকার বিরোধী ধ্বংসাত্মক ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ করার উদ্দেশ্যে গোপন বৈঠকে বসে। গোপনে এ সংবাদ পায় পুলিশ। তাৎক্ষণিক ভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে অফিসার ইনচার্জ মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তিনি (এসআই মো. জসিম উদ্দিন) ও সঙ্গীয় ফোর্স আলী নেওয়াজের বসত বাড়িতে উপস্থিত হন। তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সেখানে বৈঠকরত জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় কয়েকজন আসামি মো. নাছির উদ্দিন মেম্বার (৪৫), মো. ছিদ্দিকুর রহমান (৪৯), সিরাজুল ইসলাম শিশু (৫৩), মো. কাদির খন্দকার (৫৩), মো. মঈন উদ্দিন ভূঁইয়া (৬৫), মো. আলমগীর ভূইয়া (৪৫), মো. আক্তার হোসেন (২৮), আবু তাহের চৌধুরী (৪৫), মবুল্লা (৫০), মো. শাহআলম (৩৩), খাইরুল বাশার (৪৩) কে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্য আসামিরা পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া আসামিদের নাম তারা গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারেন। মামলাটিতে মোট ৩২ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ১৪ থেকে ১৭ নম্বর আসামি করা হয় কাজী শফিকুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইসলামী শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন (৩২), প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক কামাল উদ্দিন আহমেদ (৪০), ইসলামী ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক মো. শামসুদ্দিন মৃধা (৩৮) ও দর্শন বিভাগের প্রভাষক মো. জাহাঙ্গীর আলম (৪৮) কে। এই ৪ শিক্ষক যৌথভাবে পুলিশ সুপারের কাছে মামলা দায়েরের পরদিন একটি আবেদন করেন। যাতে তারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী লোক বলে উল্লেখ করে বলেন তারা সরকার বিরোধী কোন কার্যকলাপে লিপ্ত নন। কোন রাজনৈতিক দলের অনুসারীও নন। এই ৪ শিক্ষক মানবজমিনকে বলেন- তারা এই মামলার বাকি ২৮ আসামির কাউকেই চিনেন না। আর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা দূরে থাক মামলায় ঘটনার যে সময় দেখানো হয়েছে ঐ সময় কলেজ শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন ও কামাল উদ্দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাসায়, শামসুদ্দিন মৃধা সরাইলে তার নিজের বাড়িতে এবং জাহাঙ্গীর আলম বিজয়নগরের পাইকপাড়া গ্রামে নিজের বাড়িতে ছিলেন। তারা আরও জানান, কলেজ শেষে তারা বরাবরই যার যার বাড়িতে ফিরে যান। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে তাদের কারোরই কোন যোগাযোগ নেই। নেই উঠাবসা। মামলার শিকার এই শিক্ষকদের একজন মো. শামসুদ্দিন মৃধা বলেন- আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন লেখক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার প্রচুর ছড়া-কবিতা রয়েছে। গত ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছড়া লিখেছি। যা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আমি জামায়াত মৌলবাদীর গোড় বিরোধী। অথচ আমাকেই এভাবে ফাসানো হলো। যা খুবই দুঃখজনক। অন্য ৩ শিক্ষকও কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। তিনি বলেন পুরো ঘটনাটিই ষড়যন্ত্রমূলক। তিনি আরও জানান- মামলায় ফাসানোর হুমকি পাচ্ছিলেন আগে থেকেই। তাকে হাসিরছলে বলা হয় সারাজীবন ছাত্রলীগ করলেন, এবার জামায়াতের মামলায় জেল খাটবেন। আমি তখন বলেছি কপালে থাকলে জেল খাটবো। তবে সেখানে বসেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখবো। কিন্তু এই কথা যে সত্যি হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। মৃধা ১৯৮৭ সালে সরাইল কলেজ সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচন করে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল) আসনে মহাজোট এমপি জিয়াউল হক মৃধার আপন চাচাতো ভাই। ইসলামপুরের এই কলেজটির বিশেষ পরিচিতি আছে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও ধূমপানমুক্ত পরিবেশের কারণে। কলেজের এখানে-ওখানে এই বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি লিখিতভাবে জানান দেয়া আছে। কিন্তু ৪ শিক্ষক রাজনীতির এমন মামলায় ফাসলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে রহস্যজনক নীরব। কলেজের অধ্যক্ষ হাফেজ শফিকুর রহমানের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বলেন আমি এই ব্যাপারে কোন কিছু জানি না। পরে আবার বলেন শিক্ষকরা মামলা হয়েছে বলে তাকে জানিয়েছেন। এ নিয়ে কলেজের নীরবতার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন মামলাতো আর কলেজের নাম দিয়ে হয়নি। মামলা হয়েছে তাদের বাড়ির ঠিকানায়। তিনি আরও জানান, তাদের কলেজ একেবারে রাজনীতিমুক্ত। তবে কলেজের বাইরে এই শিক্ষকরা কি করেন তা তার জানা নেই। বা তারা ছাত্রজীবনে কি করেছেন তাও জানেন না তিনি। এই শিক্ষকদের কখনো মিছিল-মিটিংয়ে দেখেননি বলেও জানান অধ্যক্ষ। এ বিষয়ে বিজয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল পাশা বলেন- তারা জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, তাদের বিশেষ তালিকায় এই ৪ শিক্ষকের নাম নেই। কি কারণে তাদের মামলায় ঢুকানো হলো তা ওসিই ভালো বলতে পারবেন। অনুসন্ধানে অবশ্য এ ঘটনার ভিন্ন কারণও পাওয়া গেছে।