আমি বড় হয়েছি দুই কট্টর নারীবাদী- আমার মা আর আমার খালার হাতে। ফলে নারী অধিকার ও লিঙ্গ সমতা বিষয়ক কথোপকথনে আমি অনভ্যস্ত নই। আমাদের ডিনারের আলোচনা নারী ক্ষমতায়নকেন্দ্রিক হয়ে উঠাটা অস্বাভাবিক ছিল না। বিশেষ করে আমাদের নজর ছিল বাংলাদেশের গ্রামের মেয়েদের শিক্ষার ওপর। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ছিল এমন একটি আলোচ্য বিষয়, যা প্রায়ই আলোচিত হতো। কিন্তু আমার খুব কাছের এক বন্ধু নিষ্ঠুরভাবে গণধর্ষণের শিকার ও খুন হওয়ার আগে এ বিষয়ে পূর্ণ উপলব্ধি আমার ঘটেনি। আমি তখন ছিলাম স্রেফ একজন টিনএজার। আমার বান্ধবীর ওপর হামলার নৃশংস বর্ণনা প্রকাশিত হওয়ার পর রাতারাতি জীবন সমপর্কে আমার সব ধ্যানধারণা উলটপালট হয়ে গেল। তবে সম্ভবত, সবচেয়ে অশুভ অংশ ছিল এই যে, আমার বন্ধু তার নিজের বাড়িতে এমন লোকেদের দ্বারা গণধর্ষিত হয়েছিল যাদের সে চিনতো।
আমি সব সময় বোকার মতো ভাবতাম যে, ধর্ষণ সাধারণত অপরিচিত কারও দ্বারা অন্ধকার কোন কানাগলিতে ঘটে। কিন্তু যতই এ ঘৃণ্য অপরাধ সমপর্কে পড়েছি, ততই এসব ধ্যানধারণার ইতি ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রায় ৮০ শতাংশ ধর্ষণ সংঘটিত হয় ধর্ষিতা/ধর্ষিতের পরিচিত কারও দ্বারা। প্রায় ৫০ শতাংশ ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ভুক্তভোগীর বাড়িতে অথবা বাড়ির এক মাইলের মধ্যে। আমার ওই বন্ধু ধর্ষিত হওয়ার পর, আমার কোন টিনএজ বন্ধু নিজ নিজ ঘরেও নিরাপদ বোধ করেনি। এটা ছিল অকস্মাৎ উপলব্ধি যে, যে কেউ ধর্ষিত হতে পারে।
২৩ বছর বয়সী মেডিকেল ছাত্রী জ্যোতি সিং, যে দিল্লিতে ২০১৩ সালে বাসে গণধর্ষিত ও খুন হয়, তার সমপর্কে পড়ার পর ভয়ঙ্কর ওই স্মৃতি পুনরায় ফিরে আসে আমার। জ্যোতি সিং-এর পিতামাতার কথা শুনে আমি কেঁদে ফেলি। যখন কেউ ধর্ষিত হয়, তখন ভুক্তভোগীর কষ্ট নিশ্চয়ই অতুলনীয়। কিন্তু ভুক্তভোগীর পরিবার ও বন্ধুদের ওপর ধর্ষণের যে প্রভাব পড়ে, সেসবের কথা প্রায়ই উঠে আসে না। নিজের প্রিয় কাউকে সুরক্ষিত করতে না পারার অনুভূতি অকল্পনীয়। তারা যে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে গিয়েছে, সে বিষয়ে হতাশার অনুভূতিও অপূরণীয়।
এমনও সময় ছিল, যখন আমি ভেবেছি যে জ্যোতি কিসের মধ্য দিয়ে গেছে তার বিস্তারিত পড়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এটা ছিল স্রেফ অমানবিক। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। এটা ঘটেছে এক ভারতীয় তরুণী নারীর সঙ্গে, যে কিনা নিজের এক বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখতে বের হয়েছিল। তার কোন দোষ না থাকলেও, তাকে ওই বর্বর পুরুষগুলোর হাতে পড়তে হয়েছে। দুঃখজনক হলো, জ্যোতির পরপরই এ নৃশংস চর্চার ইতি ঘটেনি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র সরবরাহকৃত উপাত্ত মোতাবেক, ভারতে ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত করার সংখ্যা ২০১২ সালে ২৪৯২৩ থেকে ২০১৩ সালে ৩৩৭০৭-এ দাঁড়িয়েছে। এসব কেবলই পরিসংখ্যান নয়, এরা হলেন ৩৩৭০৭ জন নারী ও মেয়ে। ৩৩৭০৭ জন নারীর মধ্যে কেউ কেউ ছোট্ট শিশু, যারা ভালো করে কথা বলতেই শেখেনি, বা হাঁটতেও পারে না খুব। আছেন মা, এমনকি দাদিদের বয়সী নারী, যারা নিজেদের জীবনের শেষপ্রান্তে অবস্থান করছেন। এরা হলেন নারী ও মেয়ে, আপনার আমার মতো, যারা বন্ধুদের সঙ্গে কনসার্ট দেখতে চায়, ছুটির দিন কাটাতে চায়। এরা হলো সেসব শিশু, যাদের শৈশব কেড়ে নেয়া হয়েছে, সেসব মেয়ে যারা জীবন নিয়ে শঙ্কিত, সেসব নারী যারা ধর্ষিত হলেন চিরকালের জন্য।
এ কারণেই আমি হারক্যামেপইন সমর্থন করতে পেরে খুব গর্বিত। এ প্রচারণা ভারত সরকারের ওপর নারী ও মেয়েদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে চাপ প্রয়োগের উদ্দেশে শুরু করা হয়েছে। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা, কেবলমাত্র ভারতের নয়। সারা দুনিয়ার ভুক্তভোগীরা আমাদের বৈশ্বিক সংহতি প্রাপ্য। দুনিয়ার জ্যোতিদের প্রতি, আমার টিনএজ বন্ধুটির প্রতি ও আমাদের নিজেদের প্রতিই এটি আমাদের ঋণ।
[টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের হ্যামপস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনে লেবার দলের এমপি। তিনি যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের ওমেন অ্যান্ড ইকুয়ালিটিজ সিলেক্ট কমিটির সদস্য। এছাড়া তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে। উপরের লেখাটি যুক্তরাজ্যের দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত তার নিবন্ধের অনুবাদ।]