তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। সারিবদ্ধ হয়ে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করছেন বিভিন্ন বয়সের দর্শক-শ্রোতা। সেসময় এক তরুণের কণ্ঠে শোনা গেল, ‘আজ রাতটা দারুণ কাটবে। সারারাত এখানে থাকব।’বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরের তৃতীয় দিনেও সুরের তালে মজে ছিলেন সংগীত পিপাসুরা। আর সেই সাথে মেতে ছিলো পুরো আর্মি স্টেডিয়াম। যদিও রাস্তায় যানজট ছিল চোখে পড়ার মতো। তারপরও সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়, যখন মঞ্চে শিল্পীরা সুরের আবহে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। আর আয়োজনের শুরুতেই মঞ্চে আসেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ওয়ার্দা রিহাব ও তাঁর দল। তাঁরা মনোমুগ্ধকর মনিপুরী নৃত্য পরিবেশনা করেন।
‘রাধা-কৃষ্ণ’ ও তার অমর প্রেম ইতিহাসকে নাচের মুদ্রায় তুলে ধরার প্রয়াস ছিলো।এছাড়াও তার দল লেচান, কথক চাবা, বসন্ত, গোষ্ঠ ক্রীবা, জয় জয় দেবা পরিবেশন করেন। দর্শক-শ্রোতারা তন্ময় হয়ে তাদের পরিবেশনা উপভোগ করছিলেন। এর রেশ কাটতে না কাটতেই মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য সরোদ-বাদক ইউসুফ খান। তিনি রাগ কিরওয়ানী বাজিয়ে শোনান। এরপর ধ্রুপদ ঘরানায় সরোদ পরিবেশন করেন ওয়াসিফ ডাগর। সরোদের ধ্রুপদী তালে শ্রোতাদের মাঝে সুরের তৃপ্তি ছড়িয়ে দেন এই শিল্পী। পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত ডাগর পরিবারের এই শিল্পী সরোদে বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর উপস্থাপনে মাতিয়ে তোলেন পুরো আর্মি স্টেডিয়াম।
পরবর্তী পরিবেশনা ছিলো ওস্তাদ ওয়াসিফউদ্দিন ডাগর এর। তিনি রাগ বিহাগ, শংকরা রাগে ধ্রুপদ ও রাগ সোহিনী পরিবেশন করেন। শিল্পীকে পাখওয়াজে সহযোগিতা করেন মোহন শ্যাম শর্মা, তানপুরাতে গোপেশ গওড় ও সন্তোষ কুমার। গতরাতে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের প্রধান দুটি আকর্ষণের মধ্যে একটি ছিল ভারতের প্রখ্যাত বেহালা বাদক ড. এন রাজম। তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত জগতে অন্যতম গুণী বেহালা শিল্পী হিসেবে স্বনামধন্য। তার বেহালার সুরে শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। যা উপস্থিত শ্রোতাদের করতালির ধ্বনিতেই বোঝা যায়।
সেই সাথে বেহালার সুরে সৃষ্টি অনবদ্য এক সুরের লহরি। রাত যত গভীর হতে থাকে, মঞ্চের সামনের চেয়ারগুলোও ফাঁকা হতে থাকে। এরপরও শীতের আলতো ছোঁয়া অনেককে স্পর্শ করতে পারে নি। তারা অপেক্ষা করছিলেন গুরু কড়াইকুড়ি মানি’র। যার মৃদঙ্গে ধ্রুপদী সুরের ঝংকার শোনার অপেক্ষায় ছিলেন। এরপর যখন মঞ্চে আসলেন এ উৎসবের তৃতীয় রাতকে আরও মনোমুগ্ধকর শিল্পের নৈপুণ্যের ছোঁয়া লেগেছিল উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মনে। ভারতের বিদূষী শুভা মুডগালের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের এ রাতের আসর।
গত তিন বছর ধরে আয়োজিত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব শিল্পী ও দর্শকদের অংশগ্রহণের নিরিখে এরই মধ্যে এই উপমহাদেশের তথা বিশ্বের সর্বাধিক বড় পরিসরের উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রায় ২০০জন সংগীত ও নৃত্যশিল্পী এবার অংশ নিচ্ছেন আয়োজনে। এবারের উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে। ৩০ নভেম্বর চতুর্থ দিনের উৎসব শুরু হবে সন্ধ্যা ৭টায়। চলবে পরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত। আর এতে অংশ নেবেন গুরু রাজা ও রাধা রেড্ডি (কুচিপুডি নৃত্য), গণেশ ও কুমারেশ রাজাগোপালন (কর্ণাটক বেহালা), পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা (সন্তুর), পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার (সরোদ), পণ্ডিত উল্লাস কশলকর (খেয়াল), ওস্তাদ জাকির হোসেন (একক তবলা)। আর এ দিনের মূল আকর্ষণ হিসেবে থাকছেন ওস্তাদ জাকির হোসেন।