জঙ্গিবাদী নানা সংগঠনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জোট গঠনের বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। আগে আল-কায়েদা জাতীয় সংগঠনের বিরুদ্ধে এ ধরনের জোট গঠনের প্রচেষ্টা ছিল। সাম্প্রতিককালে বেশ জোরেশোরে সেই স্থান দখল করেছে প্রধানত ইসলামিক স্টেট বা আইএস। তবে এসব জোট গঠনের বিষয়টি বিভিন্ন সরকারসমূহের সঙ্গে একান্ত নিজস্বভাবে আলোচনা করেই করা হয় এবং এটির কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। কিন্তু জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে বিশ্বব্যাপী জনগণকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টির সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
সবশেষ সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ৩৪ দেশের জোট গঠনের ঘোষণা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলাপ-আলোচনা আছে। এ জোটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বিষয়টিও এদেশসহ বহু স্থানে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই প্রশ্ন জন্ম নেয়ার পেছনে কিছু কারণও রয়েছে। ২০১৪-এর ৩রা ডিসেম্বর ব্রাসেলসে ন্যাটো কার্যালয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার পক্ষ থেকে যে ৫৯টি দেশের জোট গঠন করা হয়- সে সময়ে বাংলাদেশ তাতে সাড়া দেয়নি। ঢাকা যাতে ওই জোটে অংশগ্রহণ করে সে লক্ষ্যে এর আগে-পরে নানা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা দৃশ্যমাণ ছিল। কিন্তু তখন ঢাকার পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে যে বক্তব্য দেয়া হয় তাতে বলা হয়, এই জোটে অংশ নেয়া সঠিক হবে না। উদাহরণ হিসেবে তখন অবশ্য কেউ কেউ পাকিস্তানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ওই জোটে বাংলাদেশ আর অংশগ্রহণ করেনি।
সৌদি জোট গঠনের ঘোষণাটি বেশ আকস্মিক। এই জোট গঠনের আগে দৃশ্যমান কূটনৈতিক তৎপরতাও ছিল না। টেলিফোনে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই মূলত এই জোটটি গঠন করা হয় বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে এখন খবর পাওয়া যাচ্ছে। সৌদি আরব ইতিপূর্বে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের দমনে একটি জোট গঠন করেছিল। তবে এবারের ৩৪টি দেশের জোটটি বেশ ব্যাপক আলোচিত এবং এর মধ্যে নানা প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশসহ কোনো কোনো দেশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এখনো সৌদি আরব তাদের পক্ষ থেকে ওই জোটের বিস্তারিত কিছু জানায়নি। কিন্তু এই প্রশ্নের মীমাংসাটি হয়ে যায় ১৫ই ডিসেম্বরে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে। এর আগে-পরে অবশ্য সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আল সৌদ এক ঘোষণা দেন। এছাড়া সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও এটি সামরিক জোট হবে এমনটি প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন। যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়, তালিকাভুক্ত দেশগুলো জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-এর লক্ষ্যে সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠনের ঘোষণা দিচ্ছে। আর এ জোটের সমন্বয় কেন্দ্র গঠিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে রিয়াদে এবং এই সমন্বয় কেন্দ্রটি সামরিক অভিযানসহ জঙ্গিবাদ বিরোধী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ও উপায়সমূহ নির্ধারণ করবে।
৫২৮ শব্দের এই যৌথ ঘোষণায় জঙ্গিবাদ দমনে সামরিক জোট হয়েছে বলেই বলা হচ্ছে। কাজেই জোটটি যে দীর্ঘমেয়াদি হবে তা স্পষ্ট। এছাড়া সৌদির যুবরাজ সালমান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই মুহূর্তে জোটের মূল বিষয়টি বা ফোকাসটি থাকছে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, মিশর ও আফগানিস্তানে জঙ্গিবাদ দমন। তাহলে সৌদিদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে কিছুই জানানো হয়নি বলে যা বলা হচ্ছে তা কতোটা বিশ্বাসযোগ্য এবং বাস্তবসম্মত তা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ রয়েছে।
এই জোট গঠনটি হচ্ছে মূলত সুন্নি অধ্যুষিত দেশগুলোকে নিয়ে। এই জোটে শিয়া অধ্যুষিত ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার মতো দেশগুলোকে নেয়া হয়নি। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে যে, কেন শিয়া অধ্যুষিত দেশগুলোকে নেয়া হলো না বা তাদের জোটের বাইরে রাখা হলো। এই জোট গঠনের মধ্যদিয়ে কি বিশ্বব্যাপী সুন্নি-শিয়া বিভক্তিকরণটি চূড়ান্ত হলো এবং এটিই কি জানান দেয়া হলো আনুষ্ঠানিকভাবে? যদি তাই হয় তাহলে এতে মুসলিম দুনিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সমস্যা অনেক বেশি প্রকট হবে। কারণ বেশ কিছু দেশ শিয়া-সুন্নি বিভাজনের সমস্যায় মারাত্মকভাবে ভুগছে এবং ওই সব দেশগুলো অনেক রক্তাক্ত ঘটনার শিকার হচ্ছে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেসব দেশ সরাসরি জঙ্গিবাদ এবং সাম্প্রতিক আইএস-এর হামলার শিকার অর্থাৎ ইরাক, সিরিয়াকে না নেয়ার মধ্যদিয়ে যেসব দেশ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত তাদের বাদ দেয়ায় মূল ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোই এই জোটের বাইরে থাকবে। এছাড়া এই জোটের মধ্যদিয়ে সৌদি বনাম ইরান সঙ্কটটি আরও প্রকট হবে।
তাহলে জোট গঠনের পেছনে সৌদি স্বার্থকেই ওই দেশটি বড় করে দেখছে। কারণ পশ্চিমী দেশগুলোসহ বহু দেশ জঙ্গিবাদ বিরোধী লড়াই বিশেষ করে আইএস-এর গঠন প্রক্রিয়া এবং এর বিরুদ্ধে সৌদি ভূমিকা নিয়ে আগেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এই প্রশ্নের জবাব দিতেই জোটটি গঠিত হয়েছে কিনা সে প্রশ্নটিও বড় করে দেখা হচ্ছে। সামরিক জোটটি কি সৌদি আরবের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার ফসল, না অন্যের প্রক্সি দিতেই গঠিত হয়েছে সে প্রশ্নটিও ইতিমধ্যে উঠেছে। এখানে তুরস্কের প্রশ্নটি যদি আলোচনা করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, ওই দেশটির সক্রিয়তার প্রশ্নটি যে তাদের একান্ত নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে সে বিষয়টি স্পষ্ট। ইতিমধ্যে রাশিয়ার সাথে সিরিয়ায় আক্রমণ প্রশ্নে কিছু বিষয়ে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মতৈক্য হয়েছে। কিন্তু সৌদি জোট গঠনের পরে রাশিয়া তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কিছু প্রশ্নও প্রকাশ্যে উত্থাপন করেছে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ: ৩৪টি দেশের তালিকায় থাকা মালয়েশিয়া এবং পাকিস্তান এই জোটে তাদের সক্রিয় ভূমিকা না রাখার কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। তারা বলছেন, দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেবেন। মালয়েশিয়া বলেছে, কোনো সামরিক জোট হলে তারা থাকবেন না। পাকিস্তানের অবস্থানও একই। ইন্দোনেশিয়াসহ দশটি দেশ আগেই ৩৪টি দেশের তালিকায় নাম না লেখানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন এই জোটে অংশ নিয়েছে? আগেই বলা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমী দুনিয়ার নেতৃত্বাধীন ৫৯টি দেশের জোট গঠনের সময় বাংলাদেশ তাতে অংশগ্রহণে আপত্তি জানায়।
সামরিক জোটে অংশগ্রহণের পরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, এখন তারা জোট গঠনের উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- আগে জোট গঠনের উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে কোনো আলোচনা না করেই সামরিক জোটে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত কতোটা যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত। আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সৌদি যৌথ বিবৃতি না দেখেই তাতে সম্মতি দিয়েছে, এটাও কতোটা বিশ্বাসযোগ্য সে নিয়েও প্রশ্ন আছে।
সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট অন্য সাধারণ জোটের মতো নয়। তাছাড়া এই সামরিক জোট গঠনের জন্য জাতিসংঘের ম্যান্ডেটের প্রয়োজন হয়, যা সৌদি জোটের ক্ষেত্রে নেই। পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃত্বাধীন ৫৯ দেশের জোটে জাতিসংঘের ম্যান্ডেট ছিল।
এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই সামরিক জোটটিতে অংশ নেয়া আর জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগ দেয়া এক কথা নয়। কারণ সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট সরাসরি অন্য দেশে গিয়ে রীতিমতো যুদ্ধে অংশ নেবে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৩ (১) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, সংসদের সম্মতি ব্যতীত যুদ্ধ ঘোষণা করা যাইবে না কিংবা প্রজাতন্ত্র কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিবে না।
এছাড়া সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ, যাতে আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা-এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র
(ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন;
সংবিধানের ১৪৫ ক অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে, এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন:
সংবিধানের এইসব অত্যাবশ্যকীয় পালনীয় বিধানগুলো সামরিক জোটে অংশগ্রহণের আগে মানা হয়নি বলেই দেখা যাচ্ছে।
এখানে অন্য আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, সুন্নি-শিয়া এমন ভাগাভাগির প্রশ্নটি বাংলাদেশে কোনোদিনই যেমন উচ্চারিতও নয়, তেমনি সাধারণ মানুষের মনোজগতে এ বিষয়টি আদৌ ক্রিয়াশীলও নয়। বাংলাদেশে ইতিহাসে এ বছরই প্রথম কতিপয় দুর্বৃত্ত শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটায়। কিন্তু বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে- সাধারণ মানুষের মধ্যে শিয়া-সুন্নি বিভাজন না করে ভ্রাতৃপ্রতীম, সৌহার্দ্যপূর্ণ এমনকি আত্মীয়তার সম্পর্কও রয়েছে। কখনই এই বিভাজনের প্রশ্নটি নিয়ে এই সমাজ বিভক্ত হয়নি এবং এখনো নয়।
কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আইএস আছে কথাটি স্বীকার করে নিলে ‘তারা’ বাংলাদেশের উপর ‘হামলে’ পড়তে পারে। এই ‘তারা’ এবং ‘হামলে’ কারা পড়তে পারে প্রধানমন্ত্রী তা খোলাসা না করলেও কারোরই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি কাদের কথা বোঝাতে চাইছেন। কিন্তু এবারে ওই প্রেক্ষাপটে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে অংশ নেয়াটা কতোটা যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তবানুগ হয়েছে সে প্রশ্নটি থেকেই যায়।
তবে এ কথাটি মনে রাখতেই হবে যে, বাংলাদেশ নিজেই এখন কম-বেশি জঙ্গিবাদের আক্রমণের শিকার। বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্যোগেই জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে অংশ নিলে বাংলাদেশের নিজ উদ্যোগে জঙ্গিবাদ দমনের সেই প্রত্যয় এবং প্রচেষ্টা কি জোরদার হবে? জঙ্গিবাদ দমনে নিজ দেশের জনগণকে এবং অপরাপর রাজনৈতিক দলকে আস্থায় নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ যেখানে জরুরি, সেই পথে না গিয়ে একটি সামরিক জোটে অংশগ্রহণের ফলাফল ভবিষ্যৎ বিবেচনায় কতোটা ইতিবাচক হবে- সে প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে।