চৌদ্দ বছর ধরে ঢাকার কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শফিকুল ইসলাম। নিউজিল্যান্ড ডেইরি নামক একটি প্রতিষ্ঠানের
কর্মকর্তা জিয়ারুল হাসানের প্রাইভেটকার চালান তিনি। একযুগ আগে প্রেমের পরিণয়ে তাসলিমা বেগমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের সুখের সংসারে জন্ম নেয় দুই ছেলে মেয়ে শান্ত (১০) ও সুমাইয়া (৫)। ভালোই চলছিল তাদের ৪ সদস্যের সংসার। কিন্তু একটা সময় তাসলিমার রহস্যে ঘেরা ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পাওনাদারদের তাগাদা ও হুমকির কারণে কলাবাগানের বাসা ছাড়তে হয় শফিকুলকে। গেল বছরের নভেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জ শহরের ২নং বাবুরাইলের খানকা সংলগ্ন আমেরিকা প্রবাসী ইসমাইল হোসেনের ৬তলা ভবনের নিচ তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় শফিকুল। ওই ফ্ল্যাটটি তার শ্যালক মোশারফ ওরফে মোর্শেদুলের হোসিয়ারী কারখানার পাশে। শফিকুল সপ্তাহে একদিন ছুটি পেত। তাই সপ্তাহের বৃহস্পতিবার শুধু বাসায় আসতো। আবার শনিবার চলে যেত। ফলে শফিকুলের অনুপস্থিতিতে মোশারফ বড় বোন তাসলিমার বাসায় থাকতো। অন্যদিকে ঢাকার কলাবাগানে থাকাকালীন তাদের সঙ্গে থাকতো ছোট ভাই শরীফুল ইসলাম ও তার স্ত্রী লামিয়া। সে সুবাদে শরীফুল ও লামিয়াও শফিকুলের ফ্ল্যাটে ওঠে। দুটি রুমের একটিতে লামিয়া ও অপরটিতে তাসলিমা থাকতো। চাকরির কারণে শরীফুলও মাঝে মধ্যে রাতে বাসায় আসতো না। শফিকুল জানান, ঢাকায় চাকরির কারণে তিনি সপ্তাহে একদিন বাসায় আসতেন। তবে যেদিন ঘটনাটি ঘটে অর্থাৎ ১৫ই জানুয়ারি শুক্রবার তিনি যার অধীনে চাকরি করতেন (জিয়ারুল হাসানের) তার সঙ্গে সোনারগাঁয়ে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে রাতে ফিরেন। যে কারণে তিনি আর নারায়ণগঞ্জে আসতে পারেননি। তবে রাতে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে কথা হয়েছিল। এ ছাড়া ওইদিন তার ছোট ভাই শরীফুল ইসলামও ময়মনসিংহে গিয়েছিলেন এক বন্ধুর বিয়েতে। ঘটনার দুই সপ্তাহ আগেই সর্বশেষ তার সঙ্গে স্ত্রী তাসলিমা, ছেলে শান্ত ও মেয়ে সুমাইয়ার দেখা হয়েছিল। ওইদিন বাড়িতে শরীফুল ও লামিয়াও ছিল। ওইদিন শরীফুলের নতুন কেনা মোবাইল ফোন দিয়ে ছেলে শান্তই তাকে ও সুমাইয়াকে নিয়ে সেলফি তুলতে বলে। একই ফ্রেমে পিতা পুত্র ও মেয়ে বন্দি হলেও স্ত্রী তাসলিমা ছিলেন না সেই সেলফিতে। কারণ, তাসলিমার ছবি তোলার আগ্রহ খুব একটা ছিল না। ওই ছবিটিই (সেলফি) তাদের তোলা সর্বশেষ ছবি। গত ১৬ই জানুয়ারি শফিকুলের স্ত্রী তাসলিমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী লামিয়া, শ্যালক মোশারফের সঙ্গে তার আদরের দুই সন্তান শান্ত ও সুমাইয়াকেও গলা টিপে ও মাথায় আঘাত করে নৃশংসভাবে হত্যা করে ভাগ্নে মাহফুজ। শহরের ১নং বাবুরাইল এলাকার মোবারক শাহ্ রোডের ১৮ ও ১৯নং বাবুরাইল বালক/বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল শান্ত ও সুমাইয়া। নিষ্পাপ দুটি শিশুকেও মেরে ফেলতে পারলো? ঘাতকের বুকটা একটু কাঁপলো না। মানুষ এতো হিংস্র হয় কীভাবে? এই অবুজ শিশুরা তো কোনো দোষ করেনি। একথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন শফিকুল। তার দুচোখে তখন যেন অশ্রুর বন্যা বইতে থাকে। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি। ছেলের শেষবারের মতো তোলা একটি সেলফিই স্মৃতি হিসেবে রয়েছে তার কাছে। যে স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়াবে অনন্তকাল।