নাহ, হলো না।
সেমিফাইনাল থেকে ফাইনাল ওঠা হলো না মেহেদী হাসান মিরাজের দলের। অশ্রুসিক্ত বিদায়ই নিতে হলো বাংলাদেশকে। তবু বুক চিতিয়ে যে লড়াই করলেন মিরাজরা, স্যালুট তো প্রাপ্যই দলটার।
স্যালুট পাবেন মিরাজরা আরেকটি কারণেও।
গত কয়েক দিন ধরেই এদেশের গণমাধ্যমগুলো থেকে যে ‘অযাচিত চাপ’ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল দলটির কাঁধে, সেখানে সেমিফাইনাল পর্যন্ত আসা, কম পুঁজি নিয়েও এভাবে লড়াই করা অবশ্যই সাহসিকতার ব্যাপার!
আচ্ছা, বাংলাদেশ যদি আজ জিতে যেত?
কতটা আনন্দ-উচ্ছ্বাস হতে পারতো, সে প্রসঙ্গে না যাই।
তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কালকের পত্রিকাগুলোর শিরোনাম হতো, ‘চাপকে গুঁড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশি যুবারা স্বপ্নের ফাইনালে’
প্রিন্টেড পত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল কিংবা টিভি চ্যানেল; গত কয়েক দিন ধরেই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দলের খেলা প্রসঙ্গে একটি শব্দ বহুল উচ্চারিত হচ্ছে, ‘চাপ’।
ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ। দলও আছে দুর্দান্ত ফর্মে। প্রত্যাশার এভারেস্ট কাঁধে নিয়েও কীভাবে ক্রিকেটাররা এই চাপ সামাল দিচ্ছেন, প্রবল বিস্ময় নিয়ে এই নিয়েই দিনের পর দিন রিপোর্ট ছাপা হয়েছে পত্রিকাগুলোতে। যত হাসিমুখেই মিরাজ উত্তর দিয়েছেন না কেন, ‘কোনো চাপ-টাপ নয়, আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলাই খেলছি’, তারপরও দ্বিমুখী-ত্রিমুখী প্রশ্নের ফলা কতবারই না বিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে অধিনায়ককে!
শুধু তাই-ই নয়, সেমিফাইনাল ম্যাচের আগের দিন পর্যন্তও বেশিরভাগ পত্রিকাগুলোর যেন একই সুর, ‘চাপ কি একটুও টলাচ্ছে না মিরাজদের?’ কিংবা ‘চাপকে জয় করতে পারবে তো বাংলাদেশ?’
অথচ শিরোনামটা হতে পারতো এমন, ‘মনের আনন্দে খেলুক মিরাজরা’
কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমগুলো অতটা দায়িত্ববান হলে তো!
আচ্ছা বয়স কত ওদের?
১৭? ১৮? কিংবা ১৯?
এখন তো ছেলেগুলোর নিজেদের মনের আনন্দে খেলার সময়! আরও কত ফার্স্টক্লাস ম্যাচ, লিগের ম্যাচ, বড় বড় ক্রিকেটারদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করা বাকী! এরপরই না এঁরা আরও শাণিত হবে, আরও পরিণত হবে! তখন না হয় প্রত্যাশার ভার চাপিয়ে দেওয়া যায়! তাই বলে এই বয়সেই ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশার চাপ! নাহ, বড্ড বেশি অবিচার হয়ে যায়!
জনগণের মুখপাত্র হিসেবে গণমাধ্যমের সুযোগ ছিল সেই চাপকে খানিকটা আলগা করার। কিন্তু তা আর হলো কই!
আজ ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের যুবারা চাপ নিয়েই খেলেছে। স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারেনি,বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানই সেট হয়ে আউট হয়েছেন। বোলিংটা পাশ মার্ক পেলেও যে দলটার মূল শক্তির জায়গাটা হলো ফিল্ডিং, সেখানে মিরাজের দল আজ নিশ্চিত ফেইল করেছে! ফিল্ডাররা বল গ্রিপ করতে পারছিলেন না, থ্রো-গুলো এলোপাথাড়ি হচ্ছিল, ব্যাকআপ ফিল্ডারও থাকছিল না কখনো কখনো।
পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছিল এই দলটা আজ ভীষণ চাপে আছে, ভীষণ নার্ভাস তাঁরা।
প্রতিটা খেলোয়াড়েরই ছোটবেলার স্বপ্ন থাকে, একদিন না একদিন দেশকে সাফল্যের ভেলায় ভাসানোর তার নাম পত্রিকায় ছাপা হবে, কয়েক কলাম জুড়ে থাকবে তার ছবি, বড় বড় টিভি রিপোর্টাররা তার ইন্টারভিউ নিবে!
নিশ্চয়ই মিরাজদের দলের সবাই-ই এই স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠেছে!
কিন্তু ইন্টারভিউয়ের ধরণ কিংবা পত্রিকার রিপোর্টই যদি এমন হয় যে খেলোয়াড়েরা উল্টো চাপ নিতে বাধ্য হয়েছে, তাহলে তা হতাশার! প্রতিদিন প্র্যাক্টিস শেষে, প্রতিটা ম্যাচশেষে ‘চাপ-প্রসঙ্গ’ তুলে দলের কাঁধে যেভাবে অযাচিত চাপ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা মেনে নেওয়ার নয়। গণমাধ্যমের দায়িত্ব অনেক বেশি, আরও অনেক বিস্তৃত।
যেখানে তিন দিন আগে দেশের শীর্ষ সারির এক পত্রিকাকে দেওয়া ইন্টারভিউতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন সেনসেশন মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সাংবাদিকদের কেমন যেন ভয় লাগে! এটা শুধু আমার নয়, সব খেলোয়াড়ের লাগে’; তখন ‘আমাদের গণমাধ্যম ব্রিটিশ গণমাধ্যমের মতো তো আর চামড়া তুলে নেয় না’- এটা ভেবে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কোনো কারণ আছে কি?