ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে গতকাল একুশে পদকপ্রাপ্তদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আরো সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত যে ভাষা সেটাকেই পর্যায়ক্রমে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষার স্বকীয়তাও রক্ষা করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেশের মানুষের মধ্যে মর্যাদাবোধ ফিরিয়ে আনতে পেরেছি, তাদের আত্মবিশ্বাসও ফিরে এসেছে। আমরা এখন মাথা উঁচু করে চলতে পারি। এ সবই একুশ আমাদের শিখিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘গত সাত বছরে দেশকে একটি মর্যাদার আসনে এনে দিতে পেরেছি, দেশের মানুষের ভেতর মর্যাদাবোধ তৈরি হয়েছে, এটাই আমাদের বড় অর্জন।’ গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। পদকপ্রাপ্তদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘পুরস্কার বড় কিছু না, আপনাদের অর্জন তার চাইতে অনেক বড়।’
মাতৃভাষায় শিক্ষা নেওয়ার পর অন্য ভাষা শিখলেই প্রকৃত শিক্ষাটা হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের সমাজকে আমি আরো একটু সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা যেটা এত রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি সেটা যেন ধারণ করতে পারি।’
একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য শেখ হাসিনা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি যে ইতিহাস সেটা আমরা বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়ে আমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করব আরো কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে।’
প্রতিনিয়ত মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী চেতনায় মাতৃভাষাকে ধারণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আজকে আমাদের ওপর বিরাট দায়িত্ব, সারা বিশ্বে যত মাতৃভাষা আছে তা সংরক্ষণ ও গবেষণার। ইতিমধ্যেই আমরা একটা মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গঠন করেছি। সেখানে বিভিন্ন মাতৃভাষা সংরক্ষণ করা হচ্ছে, গবেষণা করা হচ্ছে। সেটাও ইউনেসকোর ক্যাটাগরি-২ তে উন্নীত হয়েছে সেখানেও বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা এবং ভাষাশহীদরা মর্যাদা পেয়েছেন।’
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে এবং মন্ত্রিপরিষদসচিব শফিউল আলমের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব আকতারী মমতাজ।
নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর ১৬ জনকে প্রধানমন্ত্রী একুশে পদক প্রদান করেন। পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পদকপ্রাপ্তির সাইটেশন পাঠ করেন মন্ত্রিপরিষদসচিব শফিউল আলম।
ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, ডা. সাঈদ হায়দার, ড. জসীম উদ্দিন আহমেদকে পুরস্কার দেওয়া হয়। এই বিভাগে সৈয়দ গোলাম কিবরিয়ার (মরণোত্তর) পুরস্কার গ্রহণ করেন তাঁর বড় মেয়ে রোকেয়া বেগম।
শিল্পকলায় গৌরবজনক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অভিনেত্রী নাট্যকার ও প্রযোজক বেগম জাহানারা আহমেদ, শাস্ত্রীয় সংগীতে উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী পণ্ডিত অমরেশ রায় চৌধুরী, সংগীতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বেগম শাহীন সামাদ, নৃত্যে নৃত্যনাট্যকার আমানুল হককে একুশে পদক দেওয়া হয়। চিত্রকলায় শিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেনের (মরণোত্তর) পক্ষে তাঁর স্ত্রী সুফিয়া আনোয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি মফিদুল হক, সাংবাদিকতায় দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানকে এ বছর একুশে পদক দেওয়া হয়। গবেষণায় অধ্যাপক ড. এ বি এম আব্দুল্লাহ এবং লেখক ও নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধি মংছেন চীং মংছিনকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
ভাষা ও সাহিত্যে গৌরবজনক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কথাশিল্পী জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, অধ্যাপক ড. হায়াৎ মামুদ এবং কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজীকে এ বছর একুশে পদক প্রদান করা হয়।
পদকপ্রাপ্তদের ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের তৈরি ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি পদক, দুই লাখ টাকা, একটি সম্মাননাপত্র এবং একটি রেপ্লিকা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর-অধিদপ্তর এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কূটনৈতিক মিশনের সদস্য এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
একুশে পদকপ্রাপ্তদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আশা করি, আপনাদের মাধ্যমে দেশের মর্যাদা আরো বাড়বে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উজ্জীবিত হবে।’ তিনি বলেন, দেশে আজ অনেকেই আছেন যাঁদের আমরা মূল্যায়ন করতে পারছি না। তাঁদের ও আপনাদের মূল্যায়ন এই পুরস্কারের মধ্য দিয়ে হয় না। তবে, আমরা শুরু করেছি। আমরা চাই আপনাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক পথে চলতে পারে। অনুষ্ঠানের শুরুতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের পরিবেশনায় জাতীয় সংগীত এবং শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পরিবেশিত হলে সকলেই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন।