সোহাগী জাহান তনুর হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার চারদিক। এই মেয়েটির মতো ধর্ষণের শিকার এবং অকালে প্রাণ হারিয়েছেন কত মেয়ে? কে তাঁদের কথা মনে রাখে? সেই পরিসংখ্যান কারও মাথাব্যথার কারণ হয়? ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়া অন্যদের কাছে পরিসংখ্যান শুধুই সংখ্যা মনে হলেও ভুক্তভোগীর পরিবার জানে, এই পরিসংখ্যানের মানে কী।
১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩০৪ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১১৪ জনকে। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৩৯৩ জনের মধ্যে ১৩০ জন, ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৯৩ জনের মধ্যে ৬৬ জন, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের মধ্যে ৯৬ জন, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের মধ্যে ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫১৬ জনের মধ্যে ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৪৪ জনের মধ্যে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৮ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে। অর্থাৎ অনেক সোহাগীকে এই পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে শুধু ধর্ষণের কারণে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিসংখ্যান বলছে, (জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য) ২০০১ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হন ১৮১ জন গৃহকর্মী। তাঁদের মধ্যে ধর্ষণের পর মোট কতজনকে হত্যা করা হয়েছে, সেই পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও সংগঠনটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত বছরেই ধর্ষণের শিকার ১১ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় চারজন গৃহকর্মীকে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে যে হারে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা করার ঘটনা ঘটছে, তাতে আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন ও দুঃখিত। তনু হত্যা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের অবস্থান। এ ধরনের ঘটনা প্রমাণ করছে, ধর্ষণের মতো ঘটনাকে সরকার কম গুরুত্ব দিচ্ছে।’
তনু হত্যার প্রতিবাদে রাজপথে (শাহবাগ) নেমেছে তরুণেরাতনু হত্যার ঘটনায় বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা দেবে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ)। সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার সুষ্ঠু তদন্তের খাতিরে এখন মন্তব্য করব না। তবে সেনানিবাসের ভেতরে তনুর লাশ পাওয়া গেছে, তাই তারা এ ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।’
১৪টি দৈনিক পত্রিকা থেকে সংগৃহীত তথ্য দিয়ে বিএনডব্লিউএলএ বলছে, ২০১০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৪২৭টি। এর মধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে ২ হাজার ৭৩৪টি। গত ছয় বছরে ধর্ষণের পর ৫০৮ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। তবে হত্যা করার পরও সব পরিবার মামলা বা আইনি আশ্রয় নেয়নি। এর মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ২৮০টি ঘটনায়। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৬৮ নারী এবং মামলা হয়েছে মাত্র ১১৩টি।
সালমা আলী বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামিপক্ষ থাকে প্রভাবশালী। ফলে দেশে যে পরিমাণে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর মেরে ফেলার ঘটনা ঘটছে, সেই পরিমাণে মামলা হচ্ছে না। মামলা হলেও দীর্ঘসূত্রতা, ভয় বা টাকার বিনিময়ে আসামিপক্ষের সঙ্গে আপস করে ফেলাসহ বিভিন্ন ঘটনায় বেশির ভাগ মামলার পরিণতিও সন্তোষজনক হয় না।
শুধু বাংলাদেশেই নয়; গত বছর রাজধানীতে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত মতবিনিময় সভায় ধর্ষণের ঘটনায় নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচার পাচ্ছেন না বলে উল্লেখ করে মামলার দীর্ঘসূত্রতাকে এ জন্য মূলত দায়ী করেন বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে নয়াদিল্লিতে চলন্ত বাসে মেডিকেলছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত অন্যতম আসামি মুকেশ সিং ব্রিটিশ তথ্যচিত্র নির্মাতা লেসলি উডউইনকে এক সাক্ষাৎকার দেন। গত বছরের মার্চ মাসে বিবিসির ম্যাগাজিনে তা প্রকাশিত হয়।
সাক্ষাৎকারে মুকেশ বলেন, ধর্ষণের সময় তাঁর (মেডিকেলছাত্রী) লড়াই করা উচিত হয়নি। এই অপরাধের জন্য শাস্তি হিসেবে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড প্রসঙ্গে শীতল কণ্ঠে মুকেশ বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড মেয়েদের জন্য পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক করে তুলবে। আমরা যেমন মেয়েটিকে ধর্ষণের পরই ছেড়ে দিয়েছিলাম, এখন আর কেউ তা করবে না। এখন ধর্ষণের পর মেয়েটিকে হত্যা করা হবে।’
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের অবৈতনিক পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন ধর্ষণের হার বাড়ছে? এ বিষয়ে গবেষণা নেই। এর পেছনের কারণ জানা জরুরি।’
বর্তমানে ধর্ষণের শিকার নারী নিজেও প্রতিবাদ করছেন। অনেক সময় পুরো সমাজও ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর পাশে দাঁড়াচ্ছে। ভারতের শিল্পী ডোনা গুপ্ত তাঁর এক গানে বলেছেন, ‘চিৎকার করো মেয়ে, দেখি যত দূর গলা যায়, আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরবে থাকার দায়…আমাদের শুধু ধ্বজা ভাঙা রথে এগিয়ে চলার দায়’।
আর যে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়ে জীবন থেকেই হারিয়ে গেলেন, তার পক্ষে চিৎকার করবে কে? যদিও বা নেমে আসে মানুষ রাজপথে, তাঁরা কি পাবেন বিচার? নাকি একসময় হয়ে যাবে পরিসংখ্যান!