চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যেতে তূর্ণা এক্সপ্রেস ট্রেনের দু’টি স্নিগ্ধা (এসি চেয়ার) টিকেট প্রয়োজন আলমগীর চৌধুরীর। গত ১৬ এপ্রিলের টিকেট সংগ্রহ করতে নিয়ম অনুযায়ী ১২ এপ্রিল রাত ২টায় লাইনে দাঁড়ান তিনি। লাইনে তার সামনে কেবল দু’জন লোক ছিল। সকাল ৭টায় কয়েকজন যুবক এসে তাকে সরিয়ে দিয়ে বললেন, তারা চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষার্থী। কাউন্টারের অন্য লাইনগুলোও এ ধরনের শতাধিক শিক্ষার্থীর দখলে। আসলে তারা টিকেট কালোবাজারি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সিন্ডিকেটে রেলওয়ে পুলিশ, রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তার আত্মীয় যেমন আছে তেমনি আছে রেলের বাণিজ্যিক শাখার কর্মচারীরা, আছে বটতলী, রেয়াজুদ্দিন বাজার, নিউ মার্কেট এলাকার ফোন ফ্যাক্সের দোকানের মালিক-কর্মচারী।
এদের অনেকের কাছেই এখন সরকারি চাকরি নয়, টিকেট কালোবাজারিই হয়ে উঠেছে প্রধান এবং মূখ্য পেশা। চাকরি ও ব্যবসার আড়ালে কালোবাজারে টিকেট বিক্রি করে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন এদের অনেকেই। ফলে কখনো কখনো খবরের শিরোনাম হলেও এই অনৈতিক পেশা ছাড়তে পারছেন না তারা।
এদিকে যাত্রীরা কাউন্টারে টিকেট না পাওয়ার অভিযোগ করলেও রেল কর্তৃপক্ষ বলছে চাহিদার তুলনায় আসন সংখ্যা কম। তাই টিকেট বিক্রি শুরুর কয়েকঘন্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। অথচ কালোবাজারে ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য যাত্রীরা রেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে দায়ী করছেন।
১২ এপ্রিল রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে আলমগীর চৌধুরী বলেন, রাত দু’টায় ১৬ এপ্রিল তূর্ণা এক্সপ্রেস ট্রেনের দুটি টিকেটের জন্য আমি ৫ নম্বর লাইনে দাঁড়াই। তখন আমার সামনে কেবল দুইজন লোক ছিল। তারা নাকি চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষার্থী।
তিনি বলেন, সকাল ৭টা বাজার সাথে সাথে আমাকে সরিয়ে দিয়ে বললো, ওরা সবাই সিটি কলেজের শিক্ষার্থী। দেখলাম অন্য লাইনগুলোরও একই অবস্থা। শতাধিক শিক্ষার্থী টিকেট কাউন্টারের লাইনগুলো দখলে নিলো।
‘তাদের আচরণ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় ব্যাপারটি আমি যাচাই করলাম। ওরা সিটি কলেজের রণি নামে একজনের নাম ব্যবহার করে এসব অপকর্ম করছে। মূলত ওরাই হলো চট্টগ্রামে টিকেট কালোবাজারিদের সিন্ডিকেট।’
জানার কৌতুহল থেকে পরের দিনও স্টেশনে গিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, পরের দিনও গিয়ে দেখি ওই একই লোকগুলো লাইনে। তাদের মাঝখানে কয়েকজন নারী কালোবাজারিও রয়েছে। সাধারণ যাত্রীদের চোখ ফাঁকি দিতেই এই ধরনের প্রতারণা।
সহযোগিতায় বুকিং সহকারী:
সাবেক এক চোরাকারবারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, যাত্রীদের টিকেট দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একটি টিকেটের মধ্যে পাঁচজন করে টিকেট কেটে কি-বোর্ডের নিচে রেখে দেয় বুকিং সহকারীরা।
একজন যাত্রীকে টিকেট দেওয়ার ফাঁকে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি বিভিন্ন আকারের টিকেট কাটা হয়। বুকিং মাস্টারদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কয়েকজন সদস্য এবং তাদের কাছ থেকে অন্য কালোবাজারিরা টিকেট নেন। তাদের কাছ থেকে কিনেন যাত্রীরা।
টিকেট বিক্রয় কর্মীরা অফিস সময় শেষ হলে বান্ডিল করে নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী দালালদের কাছে টিকেট হস্তান্তর করেন। টাকা দেওয়া থাকে আগে থেকেই। সাবেক এ কালোবাজারি জানান, টিকেট দিতে দেরি হলে কোন যাত্রী প্রতিবাদ করলে উল্টো নিরাপত্তা কর্মীদের দিয়ে নাজেহাল করা হয়।
কালোবাজারে ‘ডন’ হাফিজ:
দুইদিন চেষ্টার পরও টিকেট না পেয়ে শেষ পর্যন্ত রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হাফিজের কাছ থেকে ১ হাজার ৩১২ টাকা মূল্যের দুটি এসি চেয়ার টিকেট ২ হাজার ৪০০ টাকায় নিয়েছিলেন আলমগীর চৌধুরী।
তিনি বলেন,‘আমি এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম টিকেট আরও পাওয়া যাবে কিনা। উত্তরে হাফিজ বললো আপনার যা লাগবে তা-ই দিতে পারবো। তাহলে তো কালোবাজারিদের মধ্যে সে একজন ডন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হাফিজ বলেন, আমি তো চট্টগ্রামেই নাই। ৬ মাস আগে আমাকে বদলি করা হয়েছে। কিছুদিন আগে আরও দুটি পত্রিকায় আমার নাম এসেছিল, আমি প্রতিবাদ দিয়েছি।
তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে বলে জানালে হাফিজের পাল্টা প্রশ্ন, যারা এসব অভিযোগ করছে তাদের জিজ্ঞেস করেন তো আমার চেহারা দেখেছে কিনা, রেয়াজুদ্দিন বাজারের কেউ আমার নাম বললে ধরার উপায় আছে?
কালোবাজারে টিকেট বিক্রির কথোপকথনের রেকর্ড রয়েছে জানালে এবার সুর পাল্টে যায় হাফিজের। স্বীকার করলেন একসময় একাজে যুক্ত ছিলেন। বললেন, ‘আসল কথা কি জানেন, স্টেশনে এমন কোন লোক নাই, যে কালোবাজারে টিকেট বিক্রি করে না। সবাই এটার সঙ্গে যুক্ত। তবে এখন অনেকে ছেড়ে দিয়েছে।’
‘একসময় আমিও জড়িয়ে পড়েছিলাম। কোন পাপে ধরছিল আল্লাহ জানে। আগে একবার আমার নাম আসছিল। সেটাকে ঝালাই করে এখনো আসে।’
তবে হাফিজের কথার সঙ্গে কাজের মিল পাওয়া যায়নি। বুধবার দুপুরে দুই দফা হাফিজের মোবাইলে কল দেওয়া হয়। প্রথমে বৃহস্পতিবার তূর্ণা এক্সপ্রেস ট্রেনের দুটি টিকেট পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে বুধবার বিকেল যোগাযোগ করতে বলেন। পরে একই দিনের একই ট্রেনের চারটি এসি চেয়ার টিকেট চাইলে তিনি গোধূলী ট্রেনের দিতে পারবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে রেলের চিফ কমান্ডেন্ট আমিনুর রশিদ বলেন, অনেক সময় আত্মীয় স্বজনকে দিয়ে থাকে। এটা দোষের কিছু না। তবে পেশায় জড়িয়ে অন্য কথা। বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।
কালোবাজারির সেলসম্যান!
নিউ মার্কেট এলাকায় প্রকাশ্যে রেলের টিকেট বিক্রি করেন বুরহান উদ্দিন। বাড়ি কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলায়। প্রশাসনের লোকজন বিষয়টি জানলেও তাকে আটক করা যায় না। কারণ তিনি কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি (তদন্ত) নেজাম উদ্দিনের ভাগিনা পরিচয় দেন। নেজাম বর্তমানে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত।
পুলিশ কর্মকর্তার নামকে পুঁজি করে ভালোই জমিয়েছেন টিকেট কালোবাজারি। ব্যবসা এতই ভাল যে তিনজন সেলসম্যান রাখতে হয়েছে। টিকেট সংগ্রাহকও আছেন একজন।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে টিকেট সংগ্রহ করেন ইমরুল। সমন্বয় করেন বুরহান। এছাড়া স্টেশন রোডের আলাউদ্দিন টেলিকম’র মালিক টিকেট কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।