বিথী হক, স্বদেশ নিউজ২৪.কম: অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় ঘটনার মত পিরিয়ডও শরীরের একটা সাধারণ ব্যাকরণ। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মেয়ের পিরিয়ড হয়, সপ্তাহে চার থেকে ছয়দিনে শরীর থেকে ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিলিলিটার রক্ত চলে যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে এটা আশি মিলিলিটার পর্যন্ত।
প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিক হলেও যার সাথে হয় সে স্বাভাবিক থাকতে পারে না। পেটের ব্যথায়, গায়ের ব্যথায়, পায়ের ব্যথায়, কোমরের ব্যথায় বেচারার অবস্থা তখন কাটা মুরগির মত থাকে।
তারপর কাউকে ওষুধ আনতে পাঠালে বাড়ির নারী সদস্যরা দোকানদারের সামনে গিয়ে লজ্জায় আনত মুখে এদিক-সেদিক তাকিয়ে পুরুষ মানুষের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দৌড়াদৌড়ি করে কিছু একটা ব্যবস্থা করেন। অবশ্য পুরুষ সদস্য থাকলে সে পর্যন্ত মরমে মরমে সেটা তার অবধি পৌঁছে দিতে পারলে কিছু সহজ হয়। ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার ‘মিনিস্ট্রুয়েশন’ শব্দটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে এই সকল নারীকুল “আল্লাহ দড়ি ফালাও, উডি যাই” পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। যেন পিরিয়ডটা না হওয়ার মতো কোনো অতি অপ্রয়োজনীয় বিষয় !
প্রিয় পুরুষগণ, এই পরিস্থিতি কি ভাবছেন নারীদের একার তৈরি? আপনার কোনো হাত নাই তার এই লজ্জা, হীনমণ্যতা তৈরিতে? আপনার সহপাঠিনী ক্লাসের এক কোনার চেয়ারে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে দেখে তাকে লজ্জায় ফেলে যৌনসুখ পাওয়ার ধান্দায় যখন ‘কি হইসে রে’ বলে মিচকা হাসি দেন, আপনার কি ধারণা সেটা তারা বোঝে না? সুপারশপে অমুক ব্র্যান্ডের ন্যাপকিন আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে সেলসম্যান লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনী হতে হতে পাশের সহকর্মির দিকে তাকিয়ে যে হাসি হাসে সেটা কি কেউ বোঝে না?
সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েটাকে বেকায়দায় ফেলে দেয়ার জন্য তাকে শুনিয়ে বন্ধুদের সাথে তামাশা করেন ‘দোস্ত এমনে হাঁটিস ক্যান, তোর কি পিরিয়ড হইসে নাকি’, আপনার কি ধারণা সেসব কথা মেয়েটা বোঝে না?
বউ বা গার্লফ্রেন্ডের পিরিয়ড হয়েছে এটা মানুষ জানলেও সমস্যা ! তার ডাক্তার ছেলেবন্ধুর কাছে বিষয়টা জানিয়ে কোন ওষুধের সাজেশন চাওয়াও বেশ লজ্জাজনক ! সিরিয়াসলি? পিরিয়ড কি কয়েকটা মেয়ের হয় নাকি খারাপ মেয়েদের হয় যে এটা লুকিয়ে রাখার বিষয়?
জ্বর, মাথা ব্যথা, সর্দির মত পিরিয়ডের সাময়িক শরীর খারাপ হলে সেটা জড়তা ছাড়াই মানুষকে জানানো উচিত। শরীর খারাপ জানার পরে কেউ কারণ জিজ্ঞেস করলে আর সব উত্তরের মতো পিরিয়ড চলছে এটাও সরল স্বাভাবিক উত্তর হতে পারে। এটা মেনে নিতে ছেলেদের পাশাপাশি কিছু ব্রেইনওয়াশড মেয়েদেরও ঘোরতর আপত্তি। তাদের মতে, পিরিয়ড লজ্জা স্থানের মতো একটা জিনিস, যা লোকচক্ষু এবং লোক জ্ঞাতির উর্ধ্বে থাকা আবশ্যক। এটা নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ করা উচিত, ছেলেরা এসব জানলে তো আরো অস্বস্তিকর ব্যাপার !
ফলে যেসব ছেলেরা এসময় মেয়েদের সাহায্য করতে চায় এবং আসে তারা তাদের লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে নাকি শরীরের সমস্যা কমাতে সাহায্য করবে সেটা নিয়ে বিপদে পড়ে যায় ।
সামনেই রোজার মাস । মেয়েরা যে কারণেই রোজা না রাখুক ছেলেরা তাদের নিম্নাংশের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে রোজা না থাকার কারণ জিজ্ঞেস করে যে কষে থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করে।
আমার মাকে জন্মের পর থেকে আমি রোজার মাসে দিনের বেলা না খেয়ে থাকতে দেখেছি। যখন থেকে বুঝেছি, কোন মেয়ের পক্ষেই পুরোপুরি ৩০টা রোজা রাখা সম্ভব নয়, তখন মা’র কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি কিভাবে সবগুলো রোজা রাখেন ! মা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, খেতে দেখলে মানুষে ভাববে কী না কী হয়েছে তাই তিনি রোজা না রাখলেও না খেয়ে থাকেন। এরপরে আমার আর কিছু বলার থাকে না। আমার মায়ের মতো মায়েদের সংখ্যা নেহাত কম বলে মনে হয় না।
ভাই ও বোনেরা, পিরিয়ডকে যেভাবে আপনারা ট্যাবু বানিয়ে রেখেছেন এবং সেটা অব্যহত রাখার চেষ্টা করছেন সেটা আদৌ কতখানি কাজে আসবে জানি না, কিন্তু অকাজে আসবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত । দয়া করে একটু মাথার মগজ ব্যবহার করেন, সহানুভূতিশীল হোন ।
কে রোজা রাখবে না, কেন রাখবে না এসব বেহুদা প্রশ্ন করে কোন পুরুষ বিকৃত মজা নেয়ার চেষ্টা করলে মেয়েদের নির্লিপ্ত জবাবই তাদের গালে কষে চড় বসানোর কাজ করবে। এসব যতো লুকিয়ে রাখা হবে, টিপিক্যাল বাঙ্গালী পুরুষরা তত বিকারগ্রস্ত হবে, মেয়েদের অপদস্থ করতে চাইবে ।
এখান থেকে বের হতে চাইলে নারীদেরকেই বের হয়ে আসতে হবে। আপনি-আমি মুখ বুজে থাকলে থাকতেই পারি, হাজার বছরের ঐতিহ্য আর মৌলবাদী মানসিকতার উত্তরণ আজীবনেও ঘটবে না।
সূত্র: ওমেনস চাপটার