কটিয়াদী(কিশোরগঞ্জ)থেকে সুবল চন্দ্র দাসঃ প্রচলিত দুর্বল নৌযান নিয়ন্ত্রণ আইন এবং উপযুক্ত তদারকি ব্যবস্থা গড়ে না উঠার সুযোগে বিআইডব্লিওটিএ’র এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তাদের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তর হাওরাঞ্চলে ১০ সহস্রাধিক ইঞ্জিনচালিত (লঞ্চ, কার্গো, ট্রলার) নৌযান চলাচল করছে। মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মনীতি। উপযুক্ত কাঠামো গতি ও আলোকনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাহীন এসব নৌযান প্রশি¶ণবিহীন চালক দ্বারা পরিচালনার কারণে ১৫ বছরে এ অঞ্চলে পাঁচ শতাধিক নৌ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় দেড় হাজারেরও বেশি যাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। ¶তি হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। চলতি বর্ষা মৌসুমেও হাওরাঞ্চলে ১১টিরও বেশি নৌ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ গেছে ৪০ যাত্রীর। দেশের এই বৃহত্তর হাওরাঞ্চলের নৌপথের কোথাও নেই কোনো উদ্ধার কেন্দ্র। নৌ দুর্ঘটনা ঘটার পর নারায়ণগঞ্জ কিংবা ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ, ডুবুরি দল পৌঁছতে পৌঁছতে সময় লেগে যায় ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত। আর এ কারণে হাওরাঞ্চলে সংঘটিত বড় ধরনের নৌ দুর্ঘটনাগুলোতেও উদ্ধারকারী দলের উপস্থিতি কখনও যাত্রীদের প্রাণ র¶ায় কোনো কাজে লাগেনি। এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের দাবি, নৌ দুর্ঘটনায় উদ্ধারের ব্যবস্থা না থাকালেও অবৈধ নৌযান থেকে ঘাটে ঘাটে চলে প্রভাবশালী ও পুলিশের চাঁদাবাজি।তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নৌযাননিয়ন্ত্রণ আইনকে উপে¶া করে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থায় নিয়োজিত নৌযানগুলো প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে। এ বৃহত্তর হাওরাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার নিুাঞ্চলে অবস্থিত ৩৯টি হাওর থানা, নৌযান মালিক সমিতি, ব্যবসায়ীসহ সংশিষ্ট একাধিক সূত্রমতে, গত ১৫ বছরে এ অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে পাঁচ শতাধিক নৌ দুর্ঘটনা। মৃত্যু হয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি যাত্রীর। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে শুধু ২২টি নৌ দুর্ঘটনায় শিশু ও মহিলাসহ কমপ¶ে ৫০০ যাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে পাঁচটিরও বেশি। এরমধ্যে ২০০৩ সালের ১২ এপ্রিল এমভি শরীফপুর নামে একটি দোতলা যাত্রীবাহী লঞ্চ সিলেটের শেরপুর থেকে কিশোরগঞ্জের চামড়া নৌবন্দরে আসার পথে মিঠামইন উপজেলার অদূরে নাগচিনি নদীতে কালবৈশাখীর ঝড়ের কবলে ডুবে যায়। এ ঘটনায় লঞ্চের ভেতরে ও ছাদে থাকা দুই শতাধিক যাত্রীর প্রায় সবাই লঞ্চের সঙ্গে গভীর পানির নিচে তলিয়ে যায়। পরদিন উদ্ধারকারী দল ২১ জনের লাশ উদ্ধার করতে স¶ম হয়। টানা ৮ দিন উদ্ধার অভিযান চালিয়ে নিমজ্জিত লঞ্চ থেকে আর মাত্র চারটি লাশ উদ্ধার করে বিআইডব্লিওটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ২০ এপ্রিল উদ্ধারকাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। একই বছরের ২১ এপ্রিল ৮২ জন বরযাত্রী নিয়ে এমভি মজলিশপুর নামের একটি লঞ্চ অষ্টগ্রাম থেকে পার্শ্ববর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জের উদ্দেশে যাওয়ার পথে বিকালে ভৈরবের অদূরে খোনাপাড়া এলাকায় কালবৈশাখীর কবলে পড়ে মেঘনা নদীতে ডুবে যায়। এ ঘটনায় একই পরিবারের ১০ জনসহ মোট ৪৯ বরযাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়। ২০০৭ সালের ৭ আগস্ট বাজিতপুর উপজেলার হিলচিয়া বাজার থেকে উপজেলা সদরে আসার পথে যাত্রীবাহী একটি নৌকা ঝড়ের কবলে পড়ে উল্টে গেলে ১০ জন যাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়। একই বছরের ১২ মে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থেকে মিঠামইনগামী যাত্রীবাহী এমভি চানপুর নামের একটি লঞ্চ নিকলী উপজেলার শিংপুর ইউনিয়নের গোড়াদিঘা এলাকায় কালবৈশাখীর কবলে পড়ে শতাধিক যাত্রী নিয়ে ঘোড়াউত্রা নদীতে ডুবে যায়। দু’দিন পরিচালিত উদ্ধার অভিযানে মাত্র ৪৪ যাত্রীর লাশ উদ্ধার করে উদ্ধার অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বর জেলার মিঠামইন উপজেলার কেওয়াজোর ইউনিয়নের চারিগ্রাম ও ফুলপুর গ্রামের মধ্যবর্তী হাওর পথে প্রবাহিত মেঘনার শাখা নদী আইলা দাইরা হৈসরে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও ট্রলারের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় ৭০-৭৫ ট্রলারযাত্রী নিখোঁজ হয়।