৭ কারণে এবার এইচএসসি ও সমমানের ফলাফল ভালো হয়েছে। যশোর বোর্ডের পাসের হার হঠাৎ দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়া, সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যায়ন দক্ষতা বাড়া, বিজ্ঞানের ভালো ফল, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস, খাতা দেখার ক্ষেত্রে পরীক্ষকদের নমনীয় মনোভাবকে এবার ভালো ফল হওয়ার কারণ হিসেবে দেখছেন শিক্ষা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, প্রতিবছর ফল ভালো হওয়ার ধারাবাহিকতা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে সেটি বাড়াতে গিয়ে শিক্ষার মান যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। গতকাল প্রকাশিত ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবার ফল ভালো হওয়ার অন্যতম কারণ যশোর শিক্ষা বোর্ডের চমক দেখানো ফল। গত বছরের চেয়ে এবার এই বোর্ডের পাসের হার বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। গত বছর এই বোর্ডের পাসের হার ছিল ৪৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে পাসের হার হয়েছে ৮৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। এই বোর্ডে প্রায় দ্বিগুণ পাস সব বোর্ডের সার্বিক ফলের পরিবর্তন হয়েছে। পাসের হার বেড়েছে। শিক্ষকদের ক্লাসে মনযোগী হওয়া, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বৃদ্ধি ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রবণতা একটু কমে যাওয়ার কারণে এবার ফল ভাল হওয়ার কারণ হিসেবে বলছেন বিশ্লেষকরা। যশোর বোর্ডের ভালো ফল দেখাতে উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষকদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল কি না- এ প্রশ্নের মুখে পড়েন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার কোনো প্রয়োজন নাই। আমরা এমন চাপে নেই দেশের মধ্যে। তিনি বলেন, গতবছর ফল বিপর্যয়ের পর বোর্ডের প্রতি সকল মহলের চাপ ছিল এবং এ কারণেই বোর্ডের সবাই সজাগ ছিল, সতর্ক ছিল শিক্ষক-অভিভাবকরাও এবং এর ফলে ফলাফল ভালো হয়েছে এবার। নম্বর যদি বাড়িয়ে দিতে বলি তাহলে আপনাদের (সাংবাদিক) দৃষ্টি এড়াবে না। রেজাল্টের পরে এই তথ্য পেতেন না, তখনই পেয়ে যেতেন, তাই এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। আর এটা (নম্বর বাড়িয়ে দেয়া) খাতা বিলি করার দিনই বলতে হত। মন্ত্রী এ সময় যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, তিনিই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। পরে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মজিদ বলেন, গত বছর আমাদের এইচএসসি’র ফলাফলে বিপর্যয় ঘটেছিল। শুধু ইংরেজিতে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী ফেল করেছিল। এসব নিয়ে বোর্ড বিশেষ ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এই ফল হয়েছে। এখানে অসদুপায় অবলম্বনের কোনো ?সুযোগ নেই। গত বছর পাসের হার ছিল শিক্ষার্থীদের বইমুখী হওয়া ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বোর্ড কর্মকর্তা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রচেষ্টায় ভালো ফলাফল সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন বোর্ড কর্মকর্তারা।
প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, যশোর শিক্ষা বোর্ডের চলতি বছর ১ লাখ ৩০ হাজার ৫৭২ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে পাস করেছেন ১ লাখ ৮ হাজার ৯২৯ জন। পাসের হার দাঁড়িয়েছে ৮৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪ হাজার ৫৮৬ জন। গত বছর মূলত ইংরেজিতে ফল বিপর্যয়ের কারণে বোর্ডের সার্বিক ফলাফল বিপর্যয় হয়। সেই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে বোর্ড। সাধারণ ৮টি বোর্ডের মধ্যে ফলাফলে শীর্ষ স্থান দখল করেছে যশোর। এ প্রসঙ্গে যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মাধব চন্দ্র রুদ্র জানান, আশা করেছিলাম আরও ভালো ফল হবে। ভালো ফলের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, গত বছরের ফল খারাপের পর তদন্ত কমিটি করে দেখা যায়, ইংরেজি ও পদার্থ বিজ্ঞানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করে। এছাড়া গত বছর ফল বিপর্যয়ের পর শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে নাড়া দিয়েছে। এরপর ভালো ফলাফলের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে অন্যতম উদ্যোগ হলো শিক্ষার্থীদের মূল বইয়ের দিকে মনোযোগী করা এবং শিক্ষার্থীরাও মূল বই নির্ভর হয়েছে।
ফলাফল বিশ্লেষণ করে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কাজী খলীকুজ্জামান বলেন, সৃজনশীল পড়ালেখায় শিক্ষার্থীদের উন্নতি হচ্ছে। শিক্ষকরাও বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ পদ্ধতিতে পারদর্শী হয়ে উঠছেন। এ কারণে এবারের পাসের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখনো বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শহরকেন্দ্রিক রয়েছে। শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নতমানের উপকরণ যুক্ত করা হচ্ছে। দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি শহরগুলোতে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়ায় শিক্ষার্থীরা অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই বরাবর শহরের শিক্ষার্থীরাই ভালো ফল করতে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে, এখনো নানা সমস্যায় ইন্দ্রজালে ঘেরা মফস্বলের শিক্ষা ব্যবস্থা।
যশোর বোর্ডের নাটকীয় ফল পরিবর্তনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. একরামূল কবির বলেন, প্রতি বছর বোর্ডের ফলাফল পরিবর্তন হতে পাবে, তবে হটাৎ করে দ্বিগুণ সূচক বেড়ে যাওয়াটা অসাভাবিক বিষয়। গত দুই বছরের ফল মূল্যায়ণ এবার ফল পুনর্মূল্যায়ন করার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, এবার ঢাকা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২৮ হাজার ১শ’ ১০ জন। প্রতিবার ঢাকা বোর্ড এ সূচকে এগিয়ে থাকছে। এতে করে বোঝা যায়, শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো শহরকেন্দ্রিক রয়ে গেছে। এ বৈষম্য পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে সরকারকে সুষম শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়েছেন এই শিক্ষাবিদ।