বাংলাদেশ সফরে যাওয়া বা না যাওয়াটা খেলোয়াড়দের নিজস্ব সিদ্ধান্ত, তবে সফরটিতে যাওয়ার পক্ষে কারণ রয়েছে অনেক- এমন কথা বলেন ইংলিশ ক্রিকেট বোদ্ধা মার্ক নিকোলাস। এক নিবন্ধে ক্রিকেটের বোদ্ধা বিশ্লেষক ও সাবেক খেলোয়াড় মার্ক নিকোলাস বলেন- ‘ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের চলতি সপ্তাহের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বাংলাদেশ সফরে যাবেন কিনা। অফিসিয়াল সিদ্ধান্তটা হলো বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছে ইংল্যান্ড দল। তবে সন্ত্রাসবাদের ভূতও রয়েছে। নিজের ইচ্ছা ও পরিবারের মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেবেন তারা। অবশ্যই, কেউ সন্ত্রাসের কাছে নতিস্বীকার করতে চায় না। তবে এটা এত সহজও নয়। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা নিজ দেশ সম্পর্কে পরিষ্কার জানে এবং এর সমস্যা ও অন্য সুবিধা-অসুবিধার মাঝে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। বাংলাদেশ তাদের কাছে অজানা দেশ। অ্যালিস্টার কুক নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে তার তরফে নির্দেশনা নেই। বাংলাদেশের খাতিরে, আমরা অবশ্যই আশা করি খেলোয়াড়রা তাকে (অ্যালিস্টার কুক) অনুসরণ করবেন। যে খেলোয়াড় তা চাইবেন না তার দোষের বা লজ্জার কিছু নেই। খুব অল্প বয়সে এমসিসি (মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব) দলের সঙ্গে আমি বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলাম। ১৯৮১ সালে ওই সফরে আমরা উঠেছিলাম ঢাকার দুই তারকাখচিত এক হোটেলে। সেখানে তেলাপোকা দেখছিলাম খুব। আমরা সেখানে ডিম খাচ্ছিলাম সবাই। যারা খাওয়া দাওয়ায় একটু সংযমী তারাও দুপুরের খাবারে এখানকার কারির স্বাদ নিয়েছিলাম বেশ। সন্ধ্যার খাবারে ছিল ফ্রাইড ও বয়েলড রাইস (ভাত, পোলাও), মুরগি ও দেশি মসলাদার রকমারি সবজি। ছিল সবুজ বোতলের কোমল পানীয়- সেভেন আপ। ওই সফরে বাংলাদেশের শক্ত কাদামাটির পিচে ভালো কিছু ক্রিকেটারের বিপক্ষে খেলছিলাম আমরা। কিন্তু খেলার আগে উপস্থিত দর্শকদের উন্মাদনাটা ছিল অবাক করার মতো। আমাদের এমন সম্ভাষণ দেয়া হচ্ছিল যেন আমরা ভিনগ্রহের মানুষ। শুরুতে হকচকিয়ে গেলাম আমরা আর দর্শকদের মুহুর্মুহু চিৎকার উল্লাসে সম্বিত ফেরে আমাদের। খেলার মাঠে বদলে যেতে দেখলাম দর্শকদের প্রতিক্রিয়া। ম্যাচে আমাদের ভালো নৈপুণ্য দেখলেই নিশ্চুপ হয়ে পড়ছিলেন সবাই। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু নিজ দলের নৈপুণ্যে তাদের একেবারে ভিন্ন ছবি। ভাবাবেগ ও উন্মাদনায় ফেটে পড়তে দেখছিলাম তাদের। বাংলাদেশ সফরে সেই চোখ-খোলা অভিজ্ঞতাটা আমরা স্মরণে রেখেছি মমতা ভরে। সেখানে বিলাসিতা ছিল না। উদ্দেশ্যটা ছিল সরল-সোজা আর ছিল পারস্পরিক আস্থা। আমরা ছিলাম অপেশাদার খেলোয়াড়। ক্রিকেটের বিশ্বায়নটাই ছিল ওই সফরে আমাদের লক্ষ্য। একটা বিষয়- দুই মাস আগে ইসলামিক জঙ্গিদের হামলায় ঢাকার এক রেস্তরাঁয় ২৯ জন প্রাণ হারান। পরের সপ্তাহে অপর হামলায় প্রাণ যায় ৪ জনের। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সফরটা ইংল্যান্ড দলের জন্য নিরাপদ কিনা তা কেউ জানে না। একইভাবে কেউ জানে না, বাংলাদেশ দল ইংল্যান্ড সফরে কিংবা লন্ডনের কোনো দোকানে পর্যটকরা নিরাপদ কিনা। কিন্তু খেলাটা অবশ্যই চালু থাকতে হবে। নইলে খেলাধুলার অস্তিত্ব থাকবে না। ইসিবির (ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড) নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ সফর বাতিল করার কোনো কারণ নেই। নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে প্রতিটি খেলোয়াড়ের। যদি কেউ এ সফরে যেতে না চান তাহলে পরে ভিন্ন পরিস্থিতিতেও পড়তে পারেন তারা। তাদের বদলে স্কোয়াডে জায়গা নিয়ে মাঠে ভালো নৈপুণ্য দেখাতে পারেন বাকিরা। এটাই জীবন চক্র। আমরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নেই এবং এর ফলটাও মেনে নিতে হবে আমাদের। বাংলাদেশ সফরে ইংল্যান্ড দলের জন্য সুনির্দিষ্ট ও কঠোর নিরাপত্তা থাকবে। এখানে অবকাশের সুযোগ থাকবে না। নিকটবর্তী ক্যাফে, রেস্তরাঁ ও শপিং মলের বাইরে যেতে পারবেন না তারা। এর বাইরে কোনো সুযোগ থাকলে তা হবে তাদের জন্য লটারি পাওয়ার মতো। এটা এমন এক সফর হচ্ছে যেখানে খেলোয়াড়রা কঠোর অনুশীলনে থাকবেন, খেলায় কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়বেন এবং নিরাপদে গৃহে ফিরবেন। মাঠ ও দলের হোটেল ঘিরে সজাগ থাকবেন পুলিশ ও সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীরা। খেলোয়াড়দের ওপর ইংল্যান্ড দলের অধিনায়কের আলাদা ভূমিকা থাকে। ক্রিকেট এমন একটা খেলা যেখানে কোচের চেয়ে অধিনায়কের সিদ্ধান্তটাই বড়। কুকের বিষয়টা বোঝা যাচ্ছে। এ উইন মরগ্যান হয়তো পরিস্থিতি নিয়ে একটু সজাগ। ইংল্যান্ড দলের দুই কোচ ট্রেভর বেইলিস ও পল ফারব্রেসের বিষয়টা আলাদা তাৎপর্যের। ২০০৯ সালে লাহোরে সফরকারী শ্রীলঙ্কা দলের বাসে জঙ্গি হামলার ঘটনাকালে শ্রীলঙ্কা দলের সঙ্গে কাজ করছিলেন এ দুই কোচ। আর সম্প্রতি পল ফারব্রেস বলেন, বাংলাদেশ সফর বাতিল করার কোনো কারণ নেই। কেউ চাইলে যাবে নয়তো যাবে না। উভয় বিকল্পই ঠিক আছে। ঢাকা ও চ্ট্টগ্রামের পিচ সাধারণত শুষ্ক, খোলা ও মন্থর। ভারত সফরের আগে এটা ভালো রিহার্সল হতে পারে। আপনি যদি বাংলাদেশ সফরে যান, আপনি যাবেন ক্রিকেটের জন্য এবং মানুষের আনন্দের জন্য। আপনি ধর্মীয় শিক্ষাটা (গসপেল) মনে রেখে খেলাটিকে এগিয়ে অনুপ্রাণিত করবেন, যা আপনার পছন্দসই একটা জীবন দিয়েছে আপনাকে। ইংল্যান্ড দলে সফরটা বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের দারিদ্র্যের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অতি জনসংখ্যা, বৈশ্বিক উষ্ণতা আর এখন সন্ত্রাসবাদ। এটা হয়তো ‘লাকি’ দেশ নয় কিন্তু এটা দারুণ সুন্দর একটা দেশ। আর এটা একটা ক্রিকেটপ্রিয় দেশ।