মিরাজের বলে ফিন আউট হতেই তিনি আম্পায়ারের কাছে রিভিউর ইঙ্গিত করছিলেন। ততক্ষণে তাইজুল, সাব্বির, মিরাজরা দুই প্রান্তের স্টাম্প তুলে ফেলেছেন জয়ের উল্লাসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিন বুঝলো তাদের রিভিউর কোটা আর বাকি নেই। তাই এগিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিবাদন জানালেন। মাঠ ছাড়লেন বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে ১০৮ রানে হারের লজ্জা নিয়ে। ততক্ষণে মাঠে ঢুকে মিরাজকে কোলে তুলে নিয়েছেন ড্রেসিং রুমে থাকা ক্রিকেটাররা। জড়িয়ে ধরছিলেন অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমকে। সবাই ছুটছিলেন মিরাজ, মুশফিক ও সাকিবের দিকে। কেন ছুটবেন না, বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জয়টি চলে এসেছে। টেস্ট ক্রিকেটের রাজা ইংল্যান্ডকে মাত্র তিনদিনেই হারিয়ে দিয়েছে টাইগাররা। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৪৮টি টেস্ট সিরিজ খেলেছে তাতে জয় ছিল মাত্র ৩টি। তবে গতকাল ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ১-১ এ চতুর্থ সিরিজ ড্র করলো বাংলাদেশ। সবচয়ে বড় প্রাপ্তি ইংল্যান্ডকে প্রথম বার হারানোর। মুশফিকের মতেও বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা অর্জন। আর এখান থেকেই শুরু টেস্টে তাদের নতুন পথ চলা। অধিনায়ক বলেন, ‘এটি সত্যি আগেও আমরা কিছু জয় পেয়েছি। কিন্তু ইংল্যান্ডকে হারানো বাংলাদেশের অনেক বড় অর্জন। সত্যি আমরা যে টেস্টে ভালো করতে পারি সেটি প্রমাণ করা এই সিরিজে আমাদের বড় পাওয়া। এখান থেকে আমি বিশ্বাস করি আমাদের নতুন শুরু হলো। এখন আমি বলতে পারি ওয়ানডের মতো টেস্টেও যে কোনো দলকে হারাতে পারি।’
মুশফিকরা যখন মাঠে উল্লাস করছিলেন তখন মাঠে ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকারদের সঙ্গে বেশ হাসি মুখেই গল্প করছিলেন বাংলাদেশ দলের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান। সেখান থেকেই ছুটে এসে বললেন, ‘দেখেছেন আমিতো দুপুরেই বলেছিলাম যে বড় লিড বাংলাদেশের, এবার ইংল্যান্ডকে হারানো সম্ভব, আমরা আজ জিতবোই। আসলে জিতলে কমেন্ট্রি বক্সে আমাদেরও গর্বে মাথা উঁচু হয়ে যায়।’ সিরিজ ও ম্যাচ সেরা হয়েছেন তরুণ মেহেদী হাসান মিরাজ। পুরস্কার বিতরণী মঞ্চ থেকে মুশফিক তাকে অভিবাদন জানিয়ে ছুটলেন গ্যালারির দিকে। সেখানেই দাঁড়িয়ে তার বাবা তারা মিয়া। গ্যালারির রড ধরে লাফিয়ে উঠলেন বাবার কাছে। বাবাও ছেলের কপালে চুমু খেলেন। এরপরই তিনি ছুটলেন মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করা গ্রাউন্ডসম্যানদের কাছে। তাদেরও অভিবাদন জানালেন বৃষ্টির পরও দারুণ ভাবে মাঠ পরিচর্যার জন্য। সে সময় সাকিবকে দেখা গেলো অনেকটা নাচের ভঙ্গিতে ড্রেসিং রুমের দিকে ছুটতে। দল নিয়ে এরপর মুশফিক চলে গেলেন নামাজের জন্য। মুশফিক যখন নামাজে তখন মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে স্কাই টিভিতে ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক অ্যালেস্টার কুক। এরপরই তিনি হেঁটে এলেন সংবাদ সম্মেলন কক্ষের দিকে। ৬ বছর আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে বিশাল জয় দিয়ে শুরু হয়েছিল তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার। সেখান থেকে আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে এ বাংলাদেশই যে তার জীবন আবার পাল্টে দিবে তিনি হয়তো ভাবতেও পারেননি। হারের যন্ত্রণা ও লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল। চোখ ছল ছল করছিল।
সংবাদ সম্মেলনে মুশফিক কুকদের এমন হার দিতে পারাটাকে তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ইংল্যান্ড আসার আগেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল এমন উইকেট বানানোর যেখানে তিন/ চারদিনেই টেস্টের ফলাফল আসে। সে ভাবেই উইকেট করা হয়েছে। চট্টগ্রাম টেস্টে আমরা দারুণ লড়াই করেছি। একটা সময় সুযোগ তৈরি করেছিলাম যেন জিততে পারি কিন্তু হয়নি। এরপর ঢাকা টেস্টের আগে বলেছিলাম এবারও এমন সুযোগ হলে যেন জয় হাত ছাড়া না হয়। শেষ পর্যন্ত হয়নি। এটাই আমি চেয়েছিলাম যেন টেস্টে আমরা ধারাবাহিক প্রতিটি দিন ভালো খেলতে পারি। আর তা করতে পেরেছি বলেই আমরা জিততে পেরেছি। এটি আমার জন্যই নয় সবার জন্য শেখার বিষয়। টেস্টে যেন এ ভাবেই খেলতে পারি।’
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে দলের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান হুংকার দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অন্যতম শক্তি স্পিন সহায়ক উইকেট দিলে তারাও জয় এনে দেখাবেন। সাকিবদের সেই উইকেটই দেয়া হয়েছে। তারা সফলও হয়েছেন। স্পিনারদের ধন্যবাদ দিয়ে মুশফিক বলেন, ‘আসলে উইকেট বানালেই যে সফল হবে তা নয়। সাকিব, তাইজুল আর মিরাজ যেভাবে কষ্ট করে বল করেছে। সেটি ছিল আমাদের বড় পাওয়া। এছাড়া তামিম ব্যাট হাতে ছিলো অসাধারণ। ও মনে প্রাণে চাইছিল যেন ওর সেঞ্চুরির ম্যাচে টেস্ট জয় আসে। সেটিও হয়েছে। আমি বলবো ব্যাটিং-বোলিং দুটিতেই আমরা ভালো করেছি। একটা সময় দলে পারফরমার ছিল কম, এখন অনেক। তাই আমি প্রস্তুত ও বিশ্বাস করি এখন থেকে আমরা যে কোনো দলকে টেস্টেও হারানোর সুযোগ তৈরি করতে পারি।’