বিকট শব্দ। চোখের পলকে উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টর থেকে আব্দুল্লাহপুর দিয়ে চলে যায় দুটি বিলাসবহুল গাড়ি। হিন্দি গানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে অনেক দূর থেকে। কোনো পরোয়া নেই চালকদের। কারণ, তারা অভিজাত পরিবারের সন্তান। রাস্তা কাঁপিয়ে হইহুল্লোড় করতে করতে বিলাসবহুল গাড়ি চালায় তারা। প্রতিরাতেই এরকম দৃশ্য চোখে পড়ে উত্তরা, গুলশান, বনানীসহ অভিজাত এলাকায়। রাত গভীর হলেই অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে নামে এসব গাড়ি। তাদের এমন গতিতে গাড়ি চালানোয় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নগর পরিবহনের অন্য চালকরাও। বিকট হর্ন বাজানো শুরু হয় বেশ দূর থেকেই। এসব গাড়ি এখন রাতের নগরীর আতঙ্ক। দ্রুতগতির এসব গাড়ির কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। ভয়ে থাকেন পথচারী, রিকশাচালক, সিএনজি অটোরিকশা চালকরা।
উত্তরা জসিম উদ্দিন মোড় সংলগ্ন এক নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা শামীম হোসেন জানান, রাত ১টার পরই বদলে যায় উত্তরার রাজপথের পরিবেশ। অনেকটা নীরব। রাস্তাঘাটে লোকজন কম। দোকানগুলো প্রায় বন্ধ। শামীম বলেন, তখনই প্রতিযোগিতা করে গাড়ি ড্রাইভিংয়ে রাস্তায় নামে বিত্তশালী পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানরা। তারা অনেকেই তখন মাতাল থাকে। শুধু শামীমই নন, অভিজাত এলাকার বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত বখে যাওয়া কিশোর-তরুণদের বিপথগামী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ সেখানকার বাসিন্দারা।
রাতের আঁধারে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিলাসবহুল এসব গাড়ি যারা চালান তাদের ক্ষেত্রে অনেকটাই অসহায় পুলিশ। এমনটিই বললেন উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী হোসেন খান। তিনি বলেন, ওরা এত দ্রুতগতিতে গাড়ি ড্রাইভ করে যে, ওই গাড়ি থামাতে গেলে পুলিশের প্রাণও যেতে পারে। তারা রেসিং কার চালায়। দ্রুতগতির এসব গাড়ির ধারে কাছে যাওয়ারও সুযোগ নেই পুলিশের। এসব গাড়ি ধরতে গেলে পুলিশেরও সেই ধরনের গাড়ি দরকার। তাছাড়াও তারা প্রত্যেকেই প্রভাবশালী পরিবারের। কিশোর-তরুণ। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে নানা সমস্যা রয়েছে বলে জানান তিনি। বেপরোয়া এসব বিলাসী চালকদের জন্য উত্তরার রাস্তা ওয়ান ওয়ে করা হচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উদ্যোগে তা করা হবে শিগগিরই। এতে রাত ১০টার পর উত্তরায় ঢুকতে একটি রাস্তা এবং বের হতে একটি রাস্তা ব্যবহার করা হবে। অন্য রাস্তাগুলো রাতে বন্ধ থাকবে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
রাতের বেলায় তারকা হোটেল থেকে বের হয়ে অধিকাংশ গাড়ি দ্রুতগতিতে চালানো হয়। মহাখালী মোড়ে রিকশাচালক আনোয়ার জানান, রাত গভীর হলে কিছুক্ষণ পরপরই দ্রুতগতির গাড়ি গুলশান ও বনানী থেকে বের হয়। রাতে অনেক সাবধানে রিকশা চালান তিনি। তারপরও থার্টিফার্স্ট নাইটে একটি দ্রুতগতির গাড়ির ধাক্কায় রাস্তার পাশে থামানো রিকশাটি তার ভেঙে গেছে। ওই গাড়িতে থাকা তরুণ-তরুণীরা হইহুল্লোড় করছিল। আনোয়ার বলেন, ভাগ্য ভালো যে আমি তখন রিকশায় ছিলাম না। থাকলে আমি হয়তো বাঁচতাম না।
গাড়িগুলো অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রবশে করে রাত গভীর হলে। এ বিষয়ে ট্রাফিক তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রাজীব দাশ বলেন, দ্রুতগতির গাড়ি এমনকি রেসিং কার প্রায়ই গুলশান-বনানী থেকে হাতিরঝিল হয়ে কাওরানবাজার মোড় দিয়ে এদিকে ঢুকে। গাড়িগুলো ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় আসা-যাওয়া করে। এ বিষয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়াও যেসব গাড়ি বেপরোয়াভাবে চালানো হয় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় বলে জানান তিনি।
গত ৯ই জানুয়ারি দিবাগত রাতে একটি দ্রতগতির গাড়ির ধাক্কার শিকার হন প্রথম শ্রেণির একটি জাতীয় দৈনিকের আলোকচিত্রী জিয়া ইসলাম। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে দেশের বাইরে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ঘটনাটি ঘটে পান্থপথে। জিয়া ইসলামকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় গাড়িটি। বেপরোয়া গতির গাড়িটি চালাচ্ছিলেন কল্যাণ কোরাইয়া নামে এক মডেল। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, কল্যাণ তখন মাতাল ছিলেন। পেশাগত কাজ শেষে প্রায়ই মাতাল হয়ে ধানমন্ডি, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি ড্রাইভ করেন তিনি। এ ঘটনায় কল্যাণ বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
বেপরোয়া গাড়ি চালকদের কারণে আহত, নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও দায়ীদের তেমন কোনো শাস্তি হয় না। নিরীহ মানুষের প্রাণ ঝরছেই। গত ৫ই ডিসেম্বর রাত ২টার ঘটনা। বেপরোয়া গতির একটি প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাথে ওঠে প্রাণ কেড়ে নেয় দুই ছিন্নমূল নারীর। নিহতরা হলেন হাসিনা ও শাহেরা। ঘটনাস্থল রাজধানীর হাইকোর্ট সংলগ্ন সড়কের ফুটপাথ। সেখানে ঘুমিয়েছিলেন এই দুই নারী। গাড়ি থেকে শাওন নামের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে আটক করে পুলিশ। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক জানান, গাড়ি যে চালাচ্ছিলো সে এখনো পলাতক। অন্যরা আদালত থেকে জামিন নিয়েছে।
গত বছরের ১লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা কড়াকড়ি হলেও দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো এখনও নিত্যদিনের ঘটনা। বাসিন্দারা জানান, দুর্ঘটনায় আহত হলে সমঝোতায় শেষ হয়। ভুক্তভোগীরাও থানা পুলিশ পর্যন্ত পা বাড়ান না। বড় রকমের ঘটনা ঘটলেই তা জানাজানি হয়। এরকমই ঘটনা ঘটেছিল ২০১৫ সালের ১২ই অক্টোবরে। ওইদিন ঢাকার গুলশানের ৭৪ নম্বর সড়কে দুই বন্ধুর কার রেসিংয়ের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একজন রিকশাচালক ও যাত্রী আহত হন। নিহত হয় রিকশায় মায়ের কোলে থাকা তিন বছরের এক শিশু। গাড়ি চালকের আসনে ছিল সাবেক এক এমপির ভাতিজা ফারিজ রহমান (১৭)। বিষয়টি উল্লেখ করে আদালতে রিট করেছিলেন কয়েকজন আইনজীবী। কিন্তু পুলিশ ফারিজকে আটকের পরও থানা থেকে ছেড়ে দেয়। ওই শিশু হত্যার ঘটনায়ও কোনো মামলা হয়নি। বরং পুলিশ জানায়, দুটি ভিন্ন দুর্ঘটনা। এ বিষয়ে গুলশান সোসাইটির সহ-সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দুলাল বলেন, রাতের বেলায় বিকট শব্দে গাড়িগুলো রাজপথ কাঁপায়। বড়লোকের বিপথগামী ছেলেরা এসব করে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে সবসময়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা চাই আমরা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের কিছু করার থাকে না। বখে যাওয়া এসব তরুণের পক্ষে অনেক উপর থেকে তদবির করা হয় বলে জানান তিনি। এসব কারণেই দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো বা রেসিং কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।