গত অক্টোবরে মিয়ানমারের রাখাইনে এক সীমান্ত ফাঁড়িতে হামলার ঘটনায় ৯ পুলিশ নিহত হওয়ার পর সেখানে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন্সের শুরু। তবে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা বা জেনোসাইড চলেছে কিনা তা নিয়ে মত-দ্বিমত রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অফিস অব দ্যা ইউএন হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিআর) গত ৩রা ফেব্রুয়ারি ৪৩ পৃষ্ঠার একটি ফ্ল্যাশ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে ফুটে উঠেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত মৃত্যু ভয়াল বিভীষিকা। এই রিপোর্টের নির্বাচিত অংশের অবিকল তরজমার প্রথম কিস্তি ছাপা হলো আজ।
‘৬. বিচারবহির্ভূত এবং সংক্ষিপ্ত বিচারে ও অন্যান্য পন্থায় হত্যা
ওএইচসিআর-এর কাছে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী অনেক রোহিঙ্গা ভিকটিম এবং প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেছেন যে, তাদের নিকটতম কিংবা দুঃসম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের যারা এনআরএস (নর্দান রাখাইন স্টেট)-এ বসবাস করেন, তারা বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে নিহত হয়েছেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং রাখাইন গ্রামবাসীরা তাদের হত্যা করতে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
৬.১ এলোপাতাড়ি গুলিতে মৃত্যু
অনেক ভিকটিম জানিয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের অনেকেই গ্রেনেড ব্যবহার এবং নির্বিচার গুলিতে হত্যার শিকার হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এবং ওএইচসিআরের কাছে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের অন্য অনেকেই উল্লেখ করছেন যে, নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের অনেকেই গ্রেনেড ব্যবহার ও এলোপাতাড়ি গুলিতে তাৎক্ষণিকভাবে মারা গেছেন। একই ধরনের জবানবন্দি লক ডাউন এলাকার ভিকটিমদের কাছ থেকেও পাওয়া গেছে। আর এ অভিযোগ ইঙ্গিত করছে যে, সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং রাখাইন গ্রামবাসীদের কর্তৃক পরিচালিত ওই নির্বিচার হামলার ঘটনার ধরন ছিল পদ্ধতিগত, ব্যাপকভিত্তিক এবং সমন্বিত।
নির্বিচারে গুলিবর্ষণের অভিযোগসমূহ প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। আর এতে দেখা যায় যে, পলায়নপর মানুষ এবং যখন কেউ তাদের কৃষি খামারে কাজ করছিলেন, কেউ সওদা করছিলেন বাজারে, কিংবা মাছ ধরছিলেন, এ রকম অবস্থায় নির্বিচার গুলিবর্ষণ তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়। সাক্ষাৎকার প্রদানকারীদের কিছু সংখ্যক বলেছেন, তারা বুঝতেই পারছিলেন না, কোন্দিক থেকে ধেয়ে আসা বুলেট বা গ্রেনেডের স্প্রিন্টার তাদেরকে বিদ্ধ করছে। বেশ কিছু আক্রমণ কথিতমতে, ফজরের নামাজের সময় প্রত্যুষে চালানো হয়েছে। নিরাপত্তাবাহিনী এরকমের একটা সময় বেছে নিয়েছে যাতে আবছা অন্ধকারের মধ্যে রোহিঙ্গারা ভালোভাবে তাদেরকে ঠাহর করতে না পারে। নিরীহ মানুষের পক্ষে পালিয়ে যাওয়াও যাতে কঠিন হয়।
ইয়ে খাট চং গ সান এলাকার একজন ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন যে, ‘যেদিনটিতে সেনাবাহিনী আমার গ্রামে আক্রমণ চালিয়েছে, আমি ও আমার বাবা নামাজ পড়ার জন্য সবে ঘরের বাইরে এসে পা রেখেছি। তখন কানে এলো গোলাগুলির শব্দ। আমরা একটি খামারে যাই এবং সেখানে বসে খামার মালিকের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। তখনো গুলি চলছিল। আমার বাবা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, তখনই আমাদের খুব নিকটে একটি গ্রেনেড ফাটলো। আমার পিতা ও খামার মালিকের ছেলে নিহত হলেন। আর আমি এবং ওই কৃষক ভদ্রলোক গুরুতরভাবে আহত হলাম (আহত ভিকটিমের ছবি ওএইচসিআরের নথিতে রয়েছে)।’
অন্য একটি ঘটনায় কি আর গং তুং এলাকার এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ‘যেদিনটিতে সেনাবাহিনীর আক্রমণ আমি লক্ষ্য করি, তখন ভোররাত তিনটা। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। গুলিবর্ষণের শব্দ শুনে আমি জেগে উঠলাম। এবং প্রাণ বাঁচাতে আমি দৌড়াতে শুরু করলাম। একটি স্থানে লুকিয়ে থাকলাম। কিন্তু হঠাৎ একটি কঠিন বস্তু আমার শরীরে আঘাত হানলো। আমি আহত হলাম।’
২৫ বছর বয়সী এক পুরুষ সাক্ষাৎকারদাতা একই ধরনের আক্রমণের বিবরণ দিয়েছেন। এই ঘটনা ঘটেছে, দো তান এলাকায়। তার বর্ণনা, ‘১০ই অক্টোবরের সকালে সেনাবাহিনী আমাদের গ্রামে এলো। প্রথমে তারা আকাশে গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করলো। গ্রামবাসী তাদের ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। আর তখনই তারা জনগণকে হত্যা করতে শুরু করলো। আমরা সবাই পালানোর চেষ্টা করেছিলাম। আমি দৌড়াচ্ছিলাম। এসময় একটি বুলেট আমাকে বিদ্ধ করলো। আমি ধানক্ষেতে পড়ে গেলাম। আমি যেহেতু দৌড়াচ্ছিলাম তাই বুঝতে পারিনি কোনদিক থেকে বুলেট এসে আমাকে আঘাত করেছে। আমার চাচাত ভাই আমার সাহায্যে এগিয়ে এলো। বাড়িতে এনে আমার চিকিৎসা দিলো। আর এদিকে আমি যখন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম, ততক্ষণে বুলেট এসে আমার পিতার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে (ওএইচসিআরের নথিতে ওই ব্যক্তির কোমরের পেছনের অংশে গুলিবিদ্ধ হওয়ার আলোকচিত্র রয়েছে)’।
যেভাবে নির্বিচারে ও পাইকারি হারে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে তাতে এটা নিশ্চিত করে যে, গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড হামলা চালাতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে (আহতদের বিবরণ থেকে অবশ্য মর্টার ব্যবহারেরও আশঙ্কা করা চলে)। দার ঘি জার এবং ইয়ে খাট চং গ সান এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীরা স্মৃতিচারণ করেছেন যে, ‘কিভাবে তাদের গ্রামগুলোর ওপর হেলিকপ্টার থেকে আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে। তারা ওএইচসিআরের টিমের কাছে যে বিবরণ দিয়েছেন, তা বিভীষিকাপূর্ণ ও বিধ্বংসী।’
দার গাই জার এলাকার একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ‘আমাদের গ্রামে দুটি হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়েছিল। এই কপ্টার দুটি গ্রামের উপর দিয়ে বিশ মিনিট চক্কর কাটে। এবং গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফায় গুলিবর্ষণের সময় হেলিকপ্টার আকাশের বেশ উঁচুতে ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফায় তারা ঠিক ঘরের ছাদ বা উঁচু চালার উপর দিয়ে চলে যায়। আমার শ্যালকের পরিবারের সাতজনই হেলিকপ্টার হামলায় নিহত হয়েছে।’
ইয়ে টুইন কুন এলাকার এক টিনেজারের বর্ণনায়, ‘তারা একটি হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করেছিল। আমি তখন নানির বাড়িতে ছিলাম। হেলিকপ্টারটি যখন আসলো, তখন আমি আমার নানির বাড়ির সামনে কিছু ছেলের সঙ্গে খেলা করছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে ছুড়ে দেয়া গুলিতে আমি এবং অন্য বালকরা আহত হলাম। আমরা ছয় থেকে সাতজন বুলেটবিদ্ধ হলাম।’
সাক্ষাৎকারদাতাদের অনেকেই জানিয়েছেন যে, তারা তাদের এক বা একাধিক পারিবারিক সদস্য বন্ধু বা প্রতিবেশী পলায়নরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। কয়েকজন স্মরণ করেছেন যে, শত শত মানুষের সঙ্গে তারা যখন তাদের গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছিলেন, তখন তাদের ওপর বুলেট বৃষ্টি হয়েছিল।
ওএইচসিআর যেসব আহতদের ছবি তুলে নথিবদ্ধ করেছে, তাদের শরীরে ক্ষত এখনো তাজা কিংবা দেহে রেখে গেছে স্থায়ী ক্ষত।