দীর্ঘ সাড়ে ৫ বছর পর মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ ৫ জন নিহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায় হয়েছে। গতকাল মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত চালক জামির হোসেনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। একই সঙ্গে ৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয় রায়ে। গতকাল দুপুরে রায় ঘোষণা করেন বিচারক আল-মাহমুদ ফাইজুল কবীর। রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আফছারুল আমিন সন্তোষ প্রকাশ করলেও আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাধব সাহা উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছেন।
মামলার রায়ে বিচারক উল্লেখ করেন, মামলাটির তদন্তের সময় প্রকাশ পায় আসামি জামির হোসেনের ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ দুর্ঘটনার তিন বছর আগেই শেষ হয়ে যায়। অবৈধ উপায়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের একটি ভুয়া নবায়ন স্লিপ ব্যবহার করে দীর্ঘদিন গাড়ি চালাচ্ছিলেন জামির হোসেন। এছাড়া বাসের যান্ত্রিক ত্রুটিও ছিলো। বিআরটিএ’র বেঁধে দেয়া গতির চেয়ে বেশি গতিতে বাস চালাচ্ছিলেন। বাসটির ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিলো না বলেও উল্লেখ করা হয় রায়ে।
রায়কে কেন্দ্র করে মানিকগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী, সাংবাদিক ও উৎসুক জনতার উপচে পড়া ভিড় ছিল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। সকলেরই দৃষ্টি ছিল রায়ের দিকে। সকাল ১০টার দিকে জামিনে থাকা মামলার আসামি বাসচালক জামির হোসেন আদালতে হাজির হন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আসামি জামিরকে নেয়া হয় মানিকগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকের কামরায়। বিচারক আল- মাহমুদ ফাইজুল কবীর ৫৫ পৃষ্ঠার রায় আসামির সামনে পড়েন। রায় ঘোষণা শেষে আসামি জামির হোসেনকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আদালতের হাজতখানায়। তখন সে কাঁদছিল। পরে কড়া নিরাপত্তা দিয়ে তাকে পাঠানো হয় মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জামির হোসেন চুয়াডাঙ্গা জেলার দৌলতদিয়ার স্কুলপাড়া গ্রামের আবদুর রহিম বিশ্বাসের ছেলে।
তারেক মাসুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইকবাল হোসেন কচি রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তারেক মাসুদ ছিলেন আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার অকাল মৃত্যুতে দেশ একজন সম্পদ হারিয়েছে যা কখনোই পূরণ হবার নয়। তবে ঘাতক বাসচালককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ায় আমরা খুশি। আমরা চাই দ্রুত এই রায় কার্যকর হবে। আসামি জামিরের আইনজীবী মাধব সাহা সাংবাদিকদের জানান, এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। রায়ে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি সরকার পক্ষের এপিপি আফসারুল ইসলাম মনি, স্পেশাল পিপি একেএম নুরুল হুদা রুবেল। মামলার আরেক কৌঁসুলি ব্যারিস্টার আদনান জানান, রায়ে তারা সন্তুষ্ট। দেশের কীর্তিমান প্রথিতযশা ব্যক্তি নিহতের রায় এটাই হওয়া উচিত বলেও তারা মন্তব্য করেন।
“কাগজের ফুল” আলোর মুখ দেখা নিয়ে অনিশ্চিত: এদিকে তারেক মাসুদের প্রোডাকশন হাউজের সহকারী শহীদুল ইসলাম জানান, বিগ বাজেটের ছবি ছিলো কাগজের ফুল। ছবিটি আলোর মুখের দেখা নিয়ে অনিশ্চিত। ফান্ড পাওয়া যাচ্ছে না এখন। তারেক মাদুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ এখন আমেরিকায় রয়েছেন। তার বাবার মৃত্যুতে তিনি আমেরিকাতে অবস্থান করছেন। ফান্ডের জন্য চেষ্টা চলছে। সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলেও তিনি জানান।
যেভাবে ঘটেছিল দুর্ঘটনা: দিনটি ছিল ২০১৩ সালের ১৩ই আগস্ট। কাগজের ফুল সিনেমার শুটিং স্পট দেখে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার শালজানা গ্রাম থেকে ঢাকা ফিরছিলেন প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ, তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ ৯ জনের একটি দল। তখন মুষলধারে বৃষ্টিও হচ্ছিল। পথিমধ্যে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের জোকা নামক এলাকায় তাদের বহনকৃত মাইক্রোবাসটি পৌঁছালে বিপরীতগামী চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের বাসের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়। ঘাতক বাসের আঘাতে বিকট শব্দ এবং মাইক্রোসবাসটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। মাইক্রোবাসের ভেতরে রক্তাক্ত ৯টি দেহ, কেউ জীবিত আবার কেউ মৃত। তার ভেতরে পড়ে ছিল তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ প্রডাকশন সহকারী ওয়াসিম, জামাল এবং মাইক্রোবাসচালক মুস্তাফিজুর রহমানের প্রাণহীন ৫টি দেহ। দুর্ঘটনায় আহত হন তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিল্পী ঢালী আল মামুন ও তার স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম জলি।
মামলা এবং গ্রেপ্তার যেভাবে: আলোচিত এই দুর্ঘটনার পর ঘিওর থানার তৎকালীন এসআই লুৎফর রহমান বাদী হয়ে ঘিওর থানায় মামলা দায়ের করেন। দুর্ঘটনার পরের দিন বাসচালক জামির হোসেনকে মেহেরপুরে এক আত্মীয়ের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তৎকালীন ডিবি ইন্সপেক্টর আশরাফ-উল ইসলাম মামলার তদন্ত করে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসচালক জামির হোসেনের বিরুদ্ধে ২৭৯,৩৩৭,৩৩৮(ক),৩০৪ ও ৪২৭ ধারায় আদালতে চার্জশিট দেন। এ মামলায় আসামি পক্ষের দুইজন সাফাই সাক্ষীসহ মোট ২৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে আদালত। দীর্ঘ সাড়ে ৫ বছর বিচার চলার পর আলোচিত এ মামলার দুইপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক আল-মাহমুদ ফাইজুল কবীর রায় দেন।