দানিয়েল গ্রিন (৩৮)। এফবিআই এজেন্ট, দোভাষী। শুধু এজেন্টই নন, টক সিক্রেট ক্লিয়ারেন্স পাওয়া এজেন্ট। তার এসাইনমেন্ট ছিল আইসিসের একজন মূল নেতা বা অপারেটিভের বিষয়ে অনুসন্ধান করা। কিন্তু তদন্তের বদলে আইসিসের ওই সদস্যকেই বিয়ে করে ফেলেন তিনি। এফবিআইকে মিথ্যে বলে চলে যান সিরিয়ায়। আগেভাগেই এফবিআই’র তদন্তের ব্যাপারে স্বামীকে সতর্ক করে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টের রেকর্ডের উদ্ধৃতি দিয়ে এ খবর দিয়েছে অনলাইন সিএনএন। দানিয়েল গ্রিনের এ কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই পড়েছে বিব্রতকর অবস্থায়। তার এ বিষয়টি এত দিন প্রকাশ করা হয়নি। এফবিআই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আইসিসের প্রতি সহানুভূতিশীলদের নির্মল করার মিশন চালিয়ে যাচ্ছে। তারই ভেতরে তাদের একজন সদস্য আইসিসের সঙ্গে এভাবে জড়িয়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে বিস্তর। দানিয়েল গ্রিন যাকে বিয়ে করেছেন সে কোন সাধারণ সন্ত্রাসী নয়। তার নাম ডেনিস কাসপার্ট। সে একজন জার্মান র্যাপার। পরে সে আইসিসের অন্যতম নেতায় পরিণত হয়। অনলাইনে সে সহিংস এ জঙ্গি গোষ্ঠীর জন্য সদস্য সংগ্রহে বেশ প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে সন্ত্রাসবিরোধী কর্তৃপক্ষের রাডারে রাখা হয় তাকে। জার্মানিতে সে ছিল ডেসো ডগ নামে পরিচিত। এ নামটি তার র্যাপ নাম। তবে সিরিয়া গিয়ে সে নতুন নাম ধারণ করে। তার নাম হয় আবু তালহা আল আলমানি। একটি গানে সে প্রশংসা করে আল-কায়েদার প্রয়াত প্রধান ওসামা বিন লাদেনের। হুমকি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে। এ ছাড়া অনেকগুলো প্রচারণামূলক ভিডিওতে তাকে দেখা গেছে। এর মধ্যে একটি ভিডিওতে তাকে দেখা গেছে মানুষের খণ্ডিত মস্তক হাতে। তাকে বিয়ে করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দানিয়েল গ্রিন (৩৮) বুঝতে পারেন তিনি একটি ভয়াবহ ভুল করে বসেছেন। ফলে তিনি ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে পৌঁছানোর পরপরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করতে রাজি হন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে মিথ্যা বক্তব্য দেয়ার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ফলে তাকে দুবছরের জেল দেয়া হয়। সেখান থেকে তিনি গত গ্রীষ্মে মুক্তি পেয়েছেন। সিএনএন এসব তথ্য পাওয়ার পর এফবিআই একটি বিবৃতি দিয়েছে সিএনএনকে। তাতে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা ঝুঁকি চিহ্নিত করতে এবং তা কমিয়ে আনতে অনেক দিক থেকে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদনে তারা নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ জোরদার অব্যাহত রাখবে। তবে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে- এ বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। আবার বিস্তারিত মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা জন কিরবি বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে, এটা এফবিআইয়ের জন্য একটি বিস্ময়কর, বিব্রতকর পরিস্থিতি। তিনি মনে করেন, দানিয়েল গ্রিনের সিরিয়ায় প্রবেশের ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানীয় আইসিস নেতাদের অনুমোদন প্রয়োজন ছিল। জন কিরবি’র মতে, যদি বাইরে থেকে কেউ সিরিয়ায় আইসিস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশ করে তাহলে তার মাথা কেটে নেয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই (দানিয়েল গ্রিন) একজন আমেরিকান হয়ে, একজন নারী হয়ে, এফবিআইয়ের একজন কর্মী হয়ে সিরিয়ায় আবাসিক সুবিধা পাওয়া, আইসিসের একজন কুখ্যাত নেতার সঙ্গে বসবাস করতে সক্ষম হওয়া- এসব সমন্বয় ছাড়া হতে পারে না। ওয়াশিংটন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে দাখিল করা কাগজপত্রে দেখা যায়, দানিয়েল গ্রিনের আচরণকে ভয়াবহ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন প্রসিকিউটরা। তারা তার কঠোর শাস্তি চেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী এটর্নি থমাস গিলিস বলেছেন, জন-আস্থা লঙ্ঘন করেছেন গ্রিন। যেসব কর্মকর্তা তাকে নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স দিয়েছিলেন, তাদের আস্থা নষ্ট করেছেন। যাদের সঙ্গে তিনি কাজ করতেন, তাদের আস্থা নষ্ট করেছেন। আর তা করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাকে বিপন্ন করেছেন। তাসত্ত্বেও তাকে মাত্র দুবছরের শাস্তি দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় অন্যদের যে শাস্তি দেয়া হয়, তার তুলনায় দানিয়েল গ্রিনের শাস্তি অনেকটা লঘু বলে অভিযোগ করা হয়। তবে গ্রিন কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করার কারণে তাকে শাস্তি কমিয়ে দেয়া হয়। তবে ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটির সেন্টার অন ন্যাশনাল সিকিউরিটির এপ্রিলের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে আইসিসের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার বিষয়ে যেসব মার্কিনি অভিযুক্ত হয়েছে তাদের গড়ে সাড়ে ১৩ বছর করে জেল দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, অন্য মামলাগুলো যেভাবে দেখা হয়, গ্রিনের মামলার শাস্তিও সেই একইভাবে দেখা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে অন্য উদাহরণগুলো সামনে এলে তিনি আর কোনো মন্তব্য করেননি। যেহেতু গ্রিন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করেছেন, এজন্য প্রসিকিউটররা দানিয়েল গ্রিনের পরিচয়সহ তার ফাইলের কিছু অংশ প্রকাশ করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন বিচারকের কাছে। দানিয়েল গ্রিন এখন একটি হোটেল লাউঞ্জে হোস্টেস হিসেবে কাজ করেন। তিনি সিএনএন’কে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তার মামলা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে তিনি আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন। দানিয়েল গ্রিন শুধু বলেছেন, যদি আমি আপনাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলি তাহলে আমার পরিবার বিপদের মুখে পড়বে। এ ছাড়া আর কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে তার অবস্থান খুঁজে বের করে সিএনএন। তার ছবি ও ভিডিওতে নিরাপত্তার কথা ভেবে মুখ অস্পষ্ট করে দেয়া হয়। গ্রিনের এটর্নি সাবেক সহকারী ফেডারেল পাবলিক ডিফেন্ডার শন মুর বলেছেন, ওই মামলা নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না। তবে তিনি দানিয়েল গ্রিনকে স্মার্ট, দেশপ্রেমী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। নিজের কৃতকর্মের জন্য তিনি ভীষণভাবে অনুতপ্ত। উল্লেখ্য, দানিয়েল গ্রিনের জন্ম চেকোস্লোভাকিয়ায়। কিছু সময় তিনি বড় হন জার্মানিতে। অল্প বয়সেই তিনি বিয়ে করেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সেনাসদস্যকে। এর পরে তিনি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে তার ডাকনাম ড্যানি। তিনি কলেজে পড়াশোনা করেছেন ওকলাহোমায় অবস্থিত ক্যামেরন ইউনিভার্সিটিতে। এরপরে তিনি ক্লেমসন ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন গ্রাজুয়েট স্কুলে। সেখান থেকে ইতিহাসে অর্জন করেন মাস্টার্স ডিগ্রি।