কলাবাগানের এক ঘরের ছয়জনই চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত। শুধু তাই নয়, এলাকার ঘরে ঘরে জ্বর। ডাক্তার, নার্সরাও বাদ যাচ্ছেন না। জ্বরের ভয়ে অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। ১৯৫২ সালে আফ্রিকাতে প্রথম দেখা পাওয়া এই জ্বর ঢাকাসহ সারা দেশেই এখন আতঙ্ক। ধানমন্ডির কলাবাগানের লেক সার্কাসের ৯২/২-এর বাসাটি ছয় তলাবিশিষ্ট। এই বাসার চতুর্থ তলায় একই পরিবারের ছয়জনই চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত। একজন এখনো কলাবাগানের পাশে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মেডিসিন পুরুষ ওয়ার্ডের ৫ নম্বর বেডে চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রনি। বয়স ২৮। তিনি জানান, তাদের বাসার একজনের পর পর আরেক জন এই জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের বাসার আরিফুল ইসলাম, সালমা আক্তার, রাফসান জামিন, তাফিজুর জ্বরে কাবু হয়ে গেছেন। এখনো তাদের গিঁটে গিঁটে ব্যথা সারেনি। দু’বছরের শিশু রাফসানও বাদ যায়নি এ জ্বর থেকে। রনি জানান, চলতি মাসের ১৯ তারিখ রাতে হঠাৎ তার জ্বর। সঙ্গে প্রচণ্ড গিঁটে গিঁটে ব্যথা। মাথাব্যথা, বমিও হয়েছে। চামড়ায় লালচে দানা, মাংসপেশী ব্যথা অনুভব করেছেন তিনি। তিনি জানান, এই জ্বর জীবনেও দেখিনি। হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্যারাসিটামল দিয়েছেন। আর শুধু প্রচুর পানি, শরবত, ওরস্যালাইন ও ডাবের পানি খেতে বলেছেন। হাসপাতালে ১৪শ’ টাকা দিয়ে তিনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান তিনি। এগুলো হলো-সিবিসি, স্টুল আর/ ই,স্টুল সি/এসবি-সি/এস। জানান, তার এখন জ্বর নেই। চিকিৎসকরা তাকে দু-একদিনের মধ্যে ছেড়ে দিতে পারেন বলে নার্সরা জানিয়েছেন। তাদের বাসার ছাদে ফুলের টব ও কিছু গাছ আছে। সেখান থেকে এসে এই মশা কামড়াতে পারে বলে তারা সন্দেহ করছেন। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চাকরি করেন বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সুমন রায়। ২৭ বছর বয়সী সুমন বলেন, ১৭ই মে তারও চিকুনগুনিয়া জ্বর হয়েছিল। তিনি হাসপাতালেই থাকেন। এই জ্বরকে ভয়াবহ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, জ্বর ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠেছে। প্রচণ্ড ব্যথা। গিঁটে গিঁটে ব্যথা। সঙ্গে বমিও। তার ৩ দিন এই জ্বর ছিল। জ্বর সারলেও এখনো শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যথা অনুভব করছেন। তার সন্দেহ তাদের হাসপাতালের বাথরুম থেকে মশায় কামড়ের ফলে এই জ্বর হতে পারে। তিনি জানান, তার আরেক সহকর্মী ফারুক হোসেনও দুই দিন ধরে এই জ্বরে ভুগছেন। এই হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরাও এই জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের চিকিৎসক মো. সাঈদ-উজ-জামান (অপু) জানান, তাদের হাসপাতালে ২১শে মে বহির্বিভাগ দিয়ে ১৩ জন, ২২শে মে ৮ জন, ২৩শে মে ৯ জন চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত রোগী সেবা নিয়েছেন। গড়ে দুই-একজন ভর্তি হন হাসপাতালে। কলাবাগান ও তার আশপাশের হাসপাতালগুলোতেও প্রায় একই চিত্র। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ বিষয়ে আগাম সতর্কতা এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি উল্লেখ করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার বলেছেন, সমপ্রতি কলাবাগান, রামপুরা, ফার্মগেট এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছে। তবে ঢাকার সব জায়গা থেকে চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত রোগীর খবর আসছে। ঢাকার বাইরে থেকে এ সংক্রান্ত কোনো খবর এখনো পাওয়া যায়নি। তবে চট্টগ্রামের একটি নমুনা তারা পেয়েছেন। অন্যদিকে গত বছর ডিসেম্বর মাসে ১৪৫টি নমুনা এসেছিল, তার মধ্যে ৩৫টি নমুনায় চিকুনগুনিয়া রোগ ধরা পড়ে। বিশ্বে গত ৫০ বছরে চিকুনগুনিয়া রোগীর সংখ্যা ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাপমাত্রার কারণে মশার বংশবিস্তার হয়েছে। গত বছর ভারতেই এই রোগে ১২ লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে। এবছর পাকিস্তানেও চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়া যাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এবছর হঠাৎ ভারি বর্ষণ ও আসন্ন বর্ষা মৌসুমে মশার বংশবিস্তারের কারণে মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
এডিস ঈজিপ্টাই অথবা এডিস অ্যালবুপিক্টাস মশার কামড়ের মাধমে এ রোগ ছড়ায়। এবারের গরমে রাজধানীর অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসবাহিত রোগ। জীবনের জন্য এ রোগ সরাসরি হুমকি নয়, তবে এ রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর নানা শারীরিক অসঙ্গতি দেখা দেয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আর সব ভাইরাসজনিত জ্বরের মতোই এর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। প্রচুর পানি, শরবত, ওরস্যালাইন, ডাবের পানি পান করতে হবে। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল। চিকুনগুনিয়ার কোনো ভ্যাক্সিন এখন পর্যন্ত নেই। দিনের বেলা ঘুমানোর অভ্যাস থাকলে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। তাছাড়া, মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করতে হবে।
আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, এ বিষয়ে গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কাজ করছে। সব জেলায় সিভিল সার্জন ও উপজেলা পর্যায়ে মেডিকেল কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একবার চিকুনগুনিয়া জ্বর হলে জীবনে আর চিকুনগুনিয়া জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তিনি জানান, এবছর এপ্রিল ও মে মাসে এ পর্যন্ত তাদের কাছে ১৩৯টি নমুনা এসেছে। এর মধ্যে ৮৬টি নমুনায় চিকুনগুনিয়া রোগ ধরা পড়েছে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ সমপ্রতি রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলেন, চিকুনগুনিয়া রোগের প্রথমদিন থেকেই রোগীর অনেক বেশি তাপমাত্রায় জ্বর ওঠে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে, জ্বর একশ’ চার-পাঁচ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা পর্যন্ত উঠে। একই সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা হয়। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটি রোগেরই বাহক এডিস মশা। কিন্তু পার্থক্য হলো ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে আর চিকুনগুনিয়াবাহী এডিস মশা ময়লা পানিতেও জন্মে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া উভয় রোগ থেকে মুক্ত থাকতে বাড়ির আঙ্গিনাসহ সর্বত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন। তিনি জানান, চিকুনগুনিয়া যা গ্রামের ভাষায় এ জ্বরকে ল্যাংড়া জ্বর বলে।
উল্লেখ্য, রোগটি প্রথম ১৯৫২ সালে আফ্রিকাতে দেখা যায়। পরবর্তীতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন-ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়াতে এর বিস্তার দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জে প্রথম এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এই রোগ দেখা যায়। তবে এর পরে বিচ্ছিন্ন দু-একটি রোগী ছাড়া এ রোগের বড় ধরনের কোনো বিস্তার আর বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়নি।