অনলাইন ডেস্ক
06/06/2017, 11:25 PM
রাতে স্ত্রী বিছানায় চলে যাওয়ার পরও পেন লং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইউটিউবে ভিডিও দেখে সময় ব্যয় করতেন। ভাইরাল ক্লিপ বা জনপ্রিয় মিউজিক ভিডিও নয়। একটা জিনিসেই তাঁর আগ্রহ; তা হলো উড়োজাহাজ। তিনি থাকেন কম্বোডিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে। মহাসড়কের পাশের একটি গ্রামে। এক চাষির ছয় সন্তানের একজন তিনি। পেন লং যখন বেড়ে ওঠেন, তখন কম্বোডিয়া খেমাররুজ শাসনের কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় থেকে কাটিয়ে ওঠার সংগ্রাম করছে। দেশটিতে তখন কোনো ধরনের উড়োজাহাজেরই অস্তিত্ব ছিল না।
কম্বোডিয়ার ৩০ বছর বয়সী পেন লং। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্যারেজে গাড়ি মেরামতের কাজ করেন তিনি। ছোটবেলায় তিনি একটি হেলিকপ্টার দেখেন। এরপর থেকে উড়ার বাসনায় আচ্ছন্ন রয়েছেন তিনি। নিজের একটি উড়োজাহাজের স্বপ্ন সফল করতে কাজ করছেন দিনরাত। এরই মধ্যে ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে তাঁর বানানো একটি উড়োজাহাজের পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন ব্যর্থ হয়েছেন। হাল ছাড়েননি তিনি। আগামী মাসে (জুলাই) তাঁর নতুন করে বানানো সি-প্লেনের পরীক্ষামূলক ফ্লাইট।
পেন লংয়ের বয়স যখন ছয়, তখন তিনি একটি হেলিকপ্টার দেখেন। হেলিকপ্টারটি দেখার পর তাঁর মন ওড়ার বাসনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। লং বলেন, ‘আমি প্রতি রাতেই উড়োজাহাজের স্বপ্ন দেখতাম। আমি সব সময়ই নিজের একটি উড়োজাহাজ চাইতাম।’
এই উড়োজাহাজ বানানোর বিষয়টি শুধু স্বপ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। লং অল্প বয়সেই স্কুল থেকে ঝরে পড়েন। এরপর তিনি গাড়ি মেরামতের কাজ শেখেন। দেশটিতে হাই স্কুল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ব্যক্তিদের কৃষিকাজের বাইরে যে অল্প কয়েকটি পেশা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো গাড়ি মেরামতের কাজ। লং পেনের বয়স এখন ৩০। বর্তমানে তিনি নিজের একটি গ্যারেজ পরিচালনা করেন।
দীর্ঘ প্রচেষ্টায় ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম দিয়ে লং পেন একটি উড়োজাহাজ তৈরি করেন। গত বছর তাঁর তৈরি করা উড়োজাহাজের পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন ব্যর্থ হয়। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি মরিয়া। শৈশবের স্বপ্ন সার্থক করতে তিনি পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। লং বলেন, ‘আমি গোপনে উড়োজাহাজ তৈরি করা শুরু করি। মানুষ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে এই ভয় পেতাম। তাই মাঝেমধ্যে আমি রাতে কাজ করতাম।’
লংয়ের ধারণা, উড়োজাহাজের চেয়ে হেলিকপ্টার তৈরি করা বেশি জটিল। তাই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জাপানের এক আসনের একটি উড়োজাহাজের আদলে তিনি নকশা তৈরি করেন। ব্যবহৃত উপকরণ কেটে প্রায় এক বছর ধরে লং পেন উড়োজাহাজ তৈরি করেন। প্লাস্টিকের চেয়ারের পা কেটে বানানো হয় উড়োজাহাজের চালকের আসন। গাড়ির ড্যাশবোর্ড দিয়ে বানান উড়োজাহাজের কন্ট্রোল প্যানেল। উড়োজাহাজের মূল অংশটি তৈরি হয় পুরোনো গ্যাস কনটেইনার দিয়ে।
গত বছরের ৮ মার্চ বাস্তবতার মুখোমুখি হন পেন লং। তিনি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন চালু করেন। ‘রানওয়ে’তে উড়োজাহাজটিকে ধাক্কা দিয়ে সহায়তা করেন তিন ব্যক্তি। ধানখেত অভিমুখী একটি রাস্তাকে রানওয়ে হিসেবে ব্যবহার করেন লং। গ্রামবাসীরা জানান, বিমানটির উড্ডয়ন দেখতে প্রায় তিন শ লোক সেখানে উপস্থিত হন। তবে লংয়ের দাবি, সেখান প্রায় দুই হাজার লোক উপস্থিত হন।
পেন লং মোটরসাইকেলের হেলমেট পরেন। এটাই ছিল তাঁর একমাত্র নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। এরপর তিনি ককপিটের মধ্যে বসেন। উড়োজাহাজটি চলতে শুরু করে। উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের জন্য পর্যাপ্ত গতিপ্রাপ্ত হয় এবং সামান্য উচ্চতায় ওঠার পরপরই সেটি বিধ্বস্ত হয়। লং দাবি করেন, উড়োজাহাজটি ৫০ মিটার উচ্চতায় ওঠার পরই বিধ্বস্ত হয়। তিনি মাটিতে পতিত হলে উপস্থিত জনতা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
লং বলেন, ‘আমি সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম আর কাঁদছিলাম। আমি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম। কারণ, উপস্থিত জনতা আমাকে যেভাবে উপহাস করছিল, তা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।’ উড্ডয়নে ব্যর্থতার জন্য লং ৫০০ কেজি ওজনের ইঞ্জিনকে দায়ী করেন।
তবে এই ব্যর্থতা পেন লংকে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে। এই ব্যর্থতার পরপরই তিনি নতুন প্রকল্প শুরু করার দিকে মনোযোগী হন। এখন তিনি সি-প্লেন তৈরি করছেন। তাঁর ধারণা, উড্ডয়ন সক্ষমতার জন্য এই উড়োজাহাজটি তিনি হালকা করে তৈরি করতে পারবেন। এতে তাঁর আনুমানিক ব্যয় হবে ১০ হাজার মার্কিন ডলার। উড়োজাহাজটি তৈরি করতে ইতিমধ্যেই তিনি তিন হাজার মার্কিন ডলার ব্যয় করে ফেলেছেন। যেখানে দেশটির সর্বনিম্ন মাসিক মজুরি ১৫৩ ডলার এবং মোট জনসংখ্যার সাড়ে ১৩ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে, সেখানে এই খরচ কম নয়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ অর্থ দিয়ে পেন লং পুরো পরিবার নিয়ে বিদেশে অবকাশ যাপন করতে যেতে পারেন। তবে লং পেনের চিন্তা একটাই, আকাশে ওড়া। অসম্ভবকে সম্ভব করা। লং পেন বলেন, ‘আমি অন্য কোনো কিছুর জন্যই অর্থ খরচের চিন্তা করি না। উড়োজাহাজ তৈরির পেছনে অর্থ খরচ করার জন্য আমার কখনো অনুশোচনা হয় না।’
পেন লংকে নিয়ে উপহাস করা প্রতিবেশীদের বাইরেও অনেকে রয়েছেন, যাঁরা তাঁকে নিয়ে ভাবেন। স্থানীয় এক মুদির দোকানি সিন সোপহিপ বলেন, ‘এ ধরনের অদ্ভুত লোক আমি কখনো দেখিনি।’ লং পেনের বাড়ির কাছে রাস্তার পাশের এক রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী ম্যান ফ্যারি বলেন, ‘এটা আমার কাছে অস্বাভাবিক। আমাদের কম্বোডিয়ার লোকদের অন্য কেউই তাঁর মতো এ ধরনের কাজ করবে না।’
লং পেনের স্ত্রী হিং মুয়েং গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রি করেন। তিনি বলেন, তাঁদের ছোট দুটি ছেলে রয়েছে। তিনি তাঁর স্বামীর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। এরপরও তিনি তাঁর স্বামীর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না উড়োজাহাজ কীভাবে চলে এবং তাঁকে (লং) সহায়তা করার জন্য বিশেষজ্ঞ কেউই নেই। আমি তাঁকে কয়েকবার এসব বন্ধ করতে বলেছি, কারণ আমার ভয় হয়। তবে তিনি কথা শোনেননি। তিনি (লং) আশ্বস্ত করে বলেছেন, বিপজ্জনক কোনো কাজ তিনি করবেন না। কাজেই আমি তাঁর এসব কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছি।’
আগামী মাসে পানিতে পেন লং তাঁর নতুন তৈরি করা উড়োজাহাজটির পরীক্ষামূলক ফ্লাইট পরিচালনা করবেন। এই উড্ডয়নে ঝুঁকি কম হবে বলে আশাবাদী তিনি। যদিও এই উড্ডয়নের অনেক কিছুই রয়েছে লংয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। লং বলেন, ‘বিপদ হতেই পারে। আমরা বিপদের পূর্বাভাস দিতে পারি না।’
কৌশিক আহমেদ, বিবিসি অবলম্বনে।
তথ্যসূত্র : প্রথম আলো