স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর রাজনীতিতে আলোচিত হয়ে উঠে রংপুর। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বন্দি নেতাকে মুক্ত করতে ‘হামার অমপুরের ছাওয়াল এরশাদ’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টি একের পর এক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে। আর এ স্লোগানে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুর জেলার ২২ আসনের মধ্যে ২১ আসন পায় জাতীয় পার্টি। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে ৭টি আসন হারায়। সেই থেকে জাতীয় পার্টির দুর্গ বলে খ্যাত রংপুরে ধস নামে। এরশাদের নাটকীয় কর্মকাণ্ডে দীর্ঘ ২৭ বছর পর দলের অবস্থান একেবারে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ভাঙা-গড়া ও বিরোধের কারণে অনেক নেতা দল ছেড়েছে। হাতেগোনা ৪-৫ নেতা, তার ওপর নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে রংপুরে জাপার কার্যক্রম। বর্তমানে রংপুর জেলার ৬ আসনের মধ্যে ৪টি আসনের এমপি, রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ড কমিশনারসহ সবই আওয়ামী লীগের দখলে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির জোট থাকার কারণে বরাবরই আওয়ামী লীগ রংপুর সদর আসন এরশাদকে ছেড়ে দেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা রংপুর সদর আসনে দেন না কোনো দলীয় প্রার্থী। আর এ কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষুব্ধ। তারা চাইছেন এককভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দিয়ে সদর-৩ আসন দখল নেয়ার। রংপুর সিটি করপোরেশনের ২০৩ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রংপুর সদর -৩ আসন। ৪ লাখেরও বেশি ভোটার রয়েছে এ আসনে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিক আওয়ামী লীগ প্রার্থী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। করে চলেছেন গণসংযোগ ও কুশল বিনিময়। এরা হলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া এমপি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও নারী নেত্রী লতিফা শওকত। এদিকে আগামী নির্বাচনে আবারো প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে শক্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেছেন, রংপুরের রাজনীতিতে এক সময় আওয়ামী লীগের জয়জয়কার অবস্থা ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সে পরিস্থিতি বদলে যায়। আবেগের ওপর ভর করে জনপ্রিয়তা পায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। এখন সে পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করেছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে, রংপুরের উন্নয়নের প্রায় সবটাই হয়েছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে। বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা তুলনামূলক বিচারে অনেকটাই দুর্বল হওয়ায় রংপুরে আওয়ামী লীগের বিকল্প কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। তাই আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে জাতীয় পার্টি চ্যালেঞ্জেই পড়বে। নির্বাচনের পর কাছে না পাওয়ায় রংপুরের মানুষ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, কয়েক দফায় নির্বাচিত এমপি জাতীয় পার্টির হওয়ার পরও কোনো উন্নয়ন হয়নি। বেশিরভাগ সময় সংসদ সদস্য ঢাকায় থাকেন। সুখ-দুঃখে কাছে পাওয়া যায় না। এ বিষয়টি চিন্তা-ভাবনায় রেখেই আগামীতে ভোটাররা তাদের নতুন প্রতিনিধি নির্বাচনের কথা ভাবছেন। আওয়ামী লীগের শক্ত প্রার্থী থাকলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে আগের মতো সহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পেরোনোর ক্ষেত্রে এক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হতে পারে বলে স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, জেলা পরিষদের প্রশাসক থাকাকালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রংপুরের উন্নয়নে কাজ করেছেন। রংপুর বিভাগ, রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও রংপুর সিটি করপোরেশন বর্তমান সরকারের আমলেই হয়েছে। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেই তিনি প্রার্থী হতে চাইছেন। এ আসনে নারী নেত্রী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক লতিফা শওকত। তিনি রংপুরের দৃশ্যমান উন্নয়নে আরো অবদান রাখার জন্য দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। ওদিকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন সংগঠনের রংপুর মহানগর সভাপতি মোজাফ্‌ফর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মিজু ও সহ-সভাপতি কাওছার জামান বাবলা। মোজাফ্‌ফর হোসেন ও শহিদুল ইসলাম মিজু বলেছেন, দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করবেন। সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছেন। কাওছার জামান বাবলা জানিয়েছেন, তিনি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করেছেন। এবার সংসদ নির্বাচনে লড়বেন। ইতিমধ্যে তিনি প্রচারণাও শুরু করেছেন। জনগণের কাছেও যাচ্ছেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ার পর থেকে সরকারি দল বিএনপিকে কোণঠাসা করে রেখেছে। সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেতাকর্মীরা হামলা-মামলায় পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। রংপুরে বিএনপি’র রাজনীতি এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সম্প্রতি কেন্দ্রীয় থেকে রংপুর জেলা ও মহানগর বিএনপি’র নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। রংপুরের বিএনপি নেতা মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্‌ফর হোসেন জানান, আগের দূরবস্থা কাটিয়ে আমরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। তারা বলেন, সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের অপকর্ম, অনিয়ম, দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণে জনগণ আজ অতিষ্ঠ। তারা আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবে এ আমাদের বিশ্বাস। অপরদিকে জাসদের (আম্বিয়া-প্রধান) সাব্বির আহমেদ ও বাসদের আবদুল কুদ্দুস এ আসনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাব্বির আহমেদ গত নির্বাচনেও প্রার্থী ছিলেন। সাব্বির আহমেদ বলেছেন, গত নির্বাচনে তাকে পরিকল্পিতভাবে হারানো হয়েছে। আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেলে এবং নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। ইতিমধ্যে তিনি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। আবদুল কুদ্দুস জানিয়েছেন, তারা সব সময় জনগণের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য মাঠে থাকেন। জনগণও তাদের চায়।