হঠাৎ করে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে অনুপ্রবেশের সংখ্যা কমলেও শুক্রবার থেকে অনুপ্রবেশের ঢল চোখে পড়ে। টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে এসব রোহিঙ্গারা রাতের বেলায় নাফ নদ পেরিয়ে এদেশে পালিয়ে আসছে। বিশেষ করে শাহপরীরদ্বীপ, টেকনাফ পৌরসভার নাইট্যংপাড়া, হ্নীলার জাদিমুরা সীমান্ত পয়েন্ট ও বাহারছড়ার শামলাপুর সৈকত এলাকা দিয়ে দলে দলে ঢুকছে মিয়ানমারের এসব মুসলিম রোহিঙ্গারা। আজ শনিবার সকালে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৫শে আগস্টে রাখাইনে সহিংসতা শুরু হলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতন, হত্যা, বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ করতো বর্মী সেনারা। এখন নির্যাতন ও হত্যা বন্ধ হলেও বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ থেমে নেই। হঠাৎ করে সেনারা এসে হ্যান্ড মাইকিং করে মানুষদের ঘর থেকে বাহির হতে বলে। পরে অগ্নিসংযোগ করে চলে যায়। এসময় আতংকে মানুষ এগ্রাম থেকে ওগ্রামে ছুটতে থাকে। আবার অনেক গ্রাম লক্ষ কোটি কিয়াতের (মায়ানমারের মুদ্রার নাম) বিনিময়ে অগ্নিসংযোগ থেকে রেহাই পাচ্ছে। মংডুর রাম্যবিলের মোহাম্মদ আলম জানান, তাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। কিন্তু তারা ১২ টি পরিবার রয়ে যায়। এক মিলিটারি অফিসার ওই ১২ পরিবারকে ডেকে ঘর ছেড়ে দিয়ে গ্রাম ত্যাগ করতে একদিনের সময় দেয়। পরের দিন তাদের গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে সম্পূর্ণ ভষ্মিভূত করে। তারাও বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তিনি আরও জানান, তাদের পাশের গ্রাম ‘মাঙ্গালা’। ওই গ্রামের ‘হুক্কাটা’ (চেয়ারম্যান) হচ্ছে মগ (বৌদ্ধ)। ওই ‘হুক্কাটা’ সেনাবাহিনী ও বিজিপিকে এক হাজার লক্ষ কিয়াতের বিনিময়ে গ্রামটি অগ্নিসংযোগ থেকে রক্ষা করেছে। পার্শ্ববর্তী সকল গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হলেও ওই ‘মাঙ্গালা’ গ্রামটি এখনও পূর্বের অবস্থায় রয়েছে। রাখাইনের আরেক রোহিঙ্গা অধ্যুষিত থানা হচ্ছে বুছিডং। রাখাইনের পূর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। মংডু থেকে প্রায় ১০ থেকে ১২ মাইল দূরে। বুছিডং থেকে বাংলাদেশে আসতে বড় বড় পাহাড় পাড়ি দিতে হয়। গত ২৪শে সেপ্টেম্বর রোববার ওই বুছিডং থানার থাইম্মখালী গ্রাম থেকে প্রায় এক হাজারের অধিক রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। তাদের সাথে আবদুল হামিদের পুত্র মো. সলিম (২২) স্বস্ত্রীক এদেশে পালিয়ে আসার জন্য যাত্রা শুরু করেন। দিন ও রাত হেটে ব্রিজঢালা নামক বড় পাহাড়টি অতিক্রম করে মংডুর ফেরাংপ্রুতে পৌঁছে। শুক্রবার দিবাগত রাতে টেকনাফের নাইট্যং পাড়া সীমান্ত দিয়ে ঘাটের মাঝিকে ৯০ হাজার কিয়াত দিয়ে অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তারাও বাংলাদেশে আসেন। মো. সলিম জানায়, ফেরাংপ্রু পৌঁছলে সেনাবাহিনীরা তাদের ৫ দিন যাবৎ আটক করে রাখে। এসময় তাদের কোন খাদ্য দেয়নি। পাশের এক মুসলিম বিত্তবান ব্যক্তি শুকনো খাবার ও ভাত দিয়েছে। ৫ দিন পর সেনারা তাদের কিছু না বলে অন্যত্র চলে গেলে তারা দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করে রাতের বেলায় নাফ নদী পেরিয়ে এক নৌকায় ৮০ জন পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তিনি আরও জানান, গত ১৩ দিন আগে প্রায় দেড় হাজারের মতো মহিলাদের ধরে নিয়ে নে¤্রে স্কুলে বন্ধি করে রাখে। এর মধ্যে তার আপন খালা দিলমাস বেগম (৩৫) রয়েছে। কোন পুরুষ এর আশপাশে দেখলে গুলি ছোড়ে এবং আটক করে নিয়ে যায়। প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ বন্দি রাখার পর এক সেনা অফিসার (নে¤্রেেমা) এসে ছেড়ে দেয়। একই থানার চৌপ্রাং গ্রামের জোনাইদ জানান, রাখাইনে কোন কাজ কর্ম নেই। সবদিকে হাহাকার। অনেক গ্রাম ভষ্মিভুত হয়ে আঙ্গারে পরিণত হয়েছে। আবার অনেক গ্রামে বাড়ি ঘর থাকলেও জনমানব শূণ্য। যেন ভুতুড়ে নগরী। বাড়ীতে জমানো যা ছিল তা দিয়ে এতোদিন পর্যন্ত খেতে পেরেছি। সেনাদের সামনে পড়লে শরীর কাঁপতে শুরু করে। মনে হয় যেন এই মুহুর্ত শেষ দিন। ভয় আর আতংক ছাড়া এক মুহুর্ত থাকা যায়না। সব সহ্য করেও জম্মভূমি ছেড়ে আসতে চাইনি। কিন্তু পেট ক্ষুধার জ্বালা মানেনা। তাই বাধ্য হয়ে প্রথম ধাপে প্রতিবন্ধী বোন ছেনুয়ারাকে (২৫) কাঁধে নিয়ে এপারে আশ্রয়ের জন্য চলে আসি। মা-স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা পথে রয়েছে।