কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে মহামারী আকারে রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গাদাগাদি করে বসবাস করতে হচ্ছে অসংখ্য রোহিঙ্গাকে । পায়খানার কাছেই বসানো হয়েছে টিউবওয়েল। তা থেকে যে পানি উঠে আসছে তা মুখে দেয়ার মতো নয়। মারাত্মক দুর্গন্ধ। রাশিদা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারী বললেন, টিউবওয়েল থেকে যে পানি উঠছে তাতে এতটাই দুর্গন্ধ যে, তা আমরা পান করতে পারছি না। পাশেই যে পায়খানাটি বসানো হয়েছে তা ব্যবহার হরে শতাধিক পরিবার। ফলে সেখানে বিপুল পরিমাণ মল-মূত্র জমা হচ্ছে। তা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মাটির নিচে পানির সঙ্গে দুর্গন্ধযুক্ত পানি গিয়ে মিশছে। এর ফলে বাংলাদেশের এসব শরণার্থী শিবিরগুলোতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। এরই মধ্যে এ বিষয়ে সতর্কতা উচ্চারণ করা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির তেমন উন্নতি নেই। নেই পরিষ্কার পানি। নেই স্বাস্থ্য সম্মত পযয়খানা। ত্রাণ বিষয়ক কর্মীরা বলছেন, সেখানে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি অত্যাসন্ন। বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, মহামারী আকারে রোগ ছড়িয়ে পড়ার জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে মৌসুমি ভারি বৃষ্টিপাত। মাঠপর্যায়ে যেসব চিকিৎসক কাজ করছেন তারা বলছেন, ব্যাপক আকারে সেখানে ডায়রিয়া দেখা দিচ্ছে। এর শিকার শিশুরাই বেশি। আশ্রয় শিবিরগুলোর আশপাথে হাজার হাজার মানুষ এখনো খোলা স্থানে প্রতিদিন মলমূত্র ত্যাগ করে। ভারি বৃষ্টি তা ধুয়ে নিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা এলাকায়। সেই ময়লা গিয়ে মিশছে খাবার পানিতে। কুতুপালং এখন মাইলের পর মাইল শরণার্থীদের তাঁবুতে পরিণত হয়েছে এক তাঁবুর শহর। সেখানে এসব রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ে একটি ক্লিনিকে একজন মাত্র চিকিৎসক চিকিৎসা দিচ্ছেন। ক্লিনিকের বাইরে লম্বা লাইন শরণার্থীদের। ভারি বৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন চিকিৎসা পাওয়ার জন্য। এখানে দায়িত্ব পালন করেন ডাক্তার আলামুল হক। দিনে তাকে কমপক্ষে ৪০০ রোগিকে চিকিৎসা দিতে হয়। তিনি বলেছেন, শিশুদের মধ্যে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রথম দিকে দেখা যেতো অভিভাবকরা একটি বা দুটি শিশু নিয়ে আসতেন। কিন্তু এখন তারা তিন থেকে চারটি শিশুকে নিয়ে আসেন চিকিৎসা দিতে। এখন ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এতে খোলা ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। এর ফলে মহামারী আকারে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। ক্যাম্পের বিভিন্ন এলাকায় তাৎক্ষণিকভাবে অনেক কুয়া খোড়া হয়েছে। তা থেকে পানি পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পানের মতো পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। একজন রোহিঙ্গা পুরুষ পাহাড়ের ঢালে একটি পায়খানা বসানোর জন্য মাটি খুঁড়ছিলেন। হাঁটু সমান গর্ত করেছেন তিনি। বললেন, আমরা যখনই পানি সংগ্রহ করতে যাই, তখনই নলকূপে দীর্ঘ লাইন থাকে। পানি যতটুকু আছে তার চেয়ে বেশি মানুষ। আরো একটু ভাটিতে গেলে নয়াপাড়া ও লেদা শরণার্থী শিবির। সেখানে জানুয়ারির মধ্যে পানির উৎস শুকিয়ে যাচে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ হলো পয়ঃনিষ্কাশন নিয়ে। পায়খানা তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে মলমূত্রে তা ভরে যাচ্ছে। এতে শরণার্থীরা যে যেখানে পারছেন সেখানেই খোলা স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করছেন। হাসিনা বেগম নামে এক শরণার্থী নারী বলেন, পায়খানায় যাওয়ার জন্য সব সময়ই কয়েক শত মানুষের লাইন থাকে। এটা বিরাট এক সমস্যা। বিশেষ করে এ সমস্যা শিশুদের জন্য বেশি। পাহাড়ের ঢালে আরো টয়লেট আছে। কিন্তু সেগুলো ব্যবহারের মতো নয়। সব ভরে গেছে। তাই সেখানে আর কেউ যান না। রেডক্রস বলছে, এসব সমস্যায় শরণার্থী শিবিরগুলোতে পুরো মাত্রায় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন নাজুক পরিস্থিতিতে কলেরাও ছড়িয়ে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারিÑ এসব রোগ এখন ‘যদি’র ওপর নির্ভর করে না। এখন কথা হলো কখন তা ছড়িয়ে পড়বে তা-ই নিয়ে। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে পাহাড়ের গায়ে নতুন একটি টয়লেট নির্মাণ করছিলেন করিম উল্লাহ। তার পরিবারে সদস্য ১৬ জন। তাদেরকে যাতে দূরে যেতে না হয় সে জন্য তিনি এই টয়লেট নির্মাণ করছিলেন। তিনি চান না তার স্ত্রী ও কন্যারা খোলা স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করুন।