হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ফুটবল বিশ্ব, বাঁচলো আর্জেন্টিনা। কোনো প্লে-অফ নয়, কারো দিকে তাকিয়ে থেকেও নয়- দুর্দান্ত এক জয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের মূল পর্বের টিকিট নিশ্চিত করে ফেললো আর্জেন্টিনা। সরাসরিই রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলছে তারা। আর এই নতুন জীবন পাওয়া আর্জেন্টিনার নায়ক হলেন লিওনেল মেসি। তারই হ্যাটট্রিকে পয়েন্ট তালিকায় তৃতীয় হয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের টিকিট পেলো আর্জেন্টিনা। একটি নয়, দুটি নয়, ৩-১ গোলের জয়ে তিনটি গোলই তার। আর এর দুটি গোল তো একেবারেই ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝলক। অদম্য, অপ্রতিরোধ্য গতিতে তছনছ করেছেন ইকুয়েডরের রক্ষণব্যূহ। ঠিক যেন ম্যারাডোনাই। অসাধারণ একক নৈপুণ্যে প্রমাণ করলেন হাল আমলের সেরা ফুটবলার তিনিই। টানা তিন ম্যাচ গোলশূন্য ড্র করে খাদের কিনারায় চলে গিয়েছিল বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম পরাশিক্ত আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপে খেলা হবে কিনা তা নিয়েই সংশয় ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বজুড়ে। আর্জেন্টিনা ছাড়া বিশ্বকাপ! আধুনিক যুগে যে অভাবনীয়। ম্যারাডোনা উত্তর আর্জেন্টিনা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। সেই আর্জেন্টিনা গোলহীন ছিল ৪৪৬ মিনিট। আর সেই গোলখরা দূর করলেন মেসি। যে মেসি গত বছর কোপা আমেরিকার ফাইনালে চিলির কাছে আর্জেন্টিনার হারের পর অবসরেরই ঘোষণা দিয়ে ফেলেছিলেন। ‘বার্সেলোনার মেসি’কে আর্জেন্টিনার হয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না এমন সমালোচনার ধারালো তীরে বিদ্ধ হয়েই সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। পরে সবার অনুরোধে ফের গায়ে তোলেন জাতীয় দলের জার্সি। আর সেই মেসির নৈপুণ্যেই আর্জেন্টিনা ফিরে পেলো নতুন এক অধ্যায়। ১৮ খেলার মধ্যে খেলেছেন ১০টিতে। আর এতেই গোল করেন ৭টি।
দম বন্ধ অবস্থায় ছিল আর্জেন্টিনা। বাস্তবেই দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তাদের। ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে হওয়ায় সেখানে অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় সবার। হারলে বা ড্র করলে ছিটকে যাবে বিশ্বকাপ থেকেই। ১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের পর কখনো মূলপর্ব থেকে ছিটকে যায়নি তারা। আর আর্জেন্টিনা ছাড়া বিশ্বকাপ ফুটবলের রংও হয়ে যেত ফিকে। দর্শক আগ্রহ কমে যেত অনেকাংশেই। সম্প্রচার স্বত্ব যেসব টেলিভিশন চ্যানেল কিনেছে তাদের কপালেও ভাঁজ পড়ে গিয়েছিল।
প্রায় বাদ পড়তে যাওয়া গতবারের রানার্সআপরা মঙ্গলবার (বাংলাদেশ সময় বুধবার ভোর) ইকুয়েডরকে ৩-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলা নিশ্চিত করে। এ জয়ে দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের বাছাই পর্বে তৃতীয় হয়েছে আর্জেন্টিনা। এটিই ছিল এ অঞ্চলের শেষ খেলা।
খেলার প্রথম মিনিটেই (মাত্র ৪০ সেকেন্ডের সময়) ইবারার গোলে এগিয়ে গিয়েছিল স্বাগতিক ইকুয়েডর। আর্জেন্টিনা শিবিরের অবস্থা তখন কেমন হতে পারে -একটু আঁচ করুন। কিন্তু এ অবস্থা থাকেনি বেশিক্ষণ। ১১ মিনিটে গোল করে আর্জেন্টিনাকে সমতায় ফেরান বার্সেলোনা তারকা মেসি। ডি মারিয়ার সঙ্গে বল দেয়া নেয়া করে তা জালে জড়ান মেসি। এরপর ১৮ মিনিটে আরেক গোল। বাম প্রান্ত দিয়ে আক্রমণ। বল নিয়ে ছুটছিলেন তিনি। তাকে আটকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত দুই তিন ডিফেন্ডার। মেসি সময় নিলেন না। বক্সের বাইরে থেকেই বাম পায়ের জোরালো শট নিলেন তিনি। আর সেই বল উড়ে জড়িয়ে গেল জালে। গোলরক্ষকের করার ছিল না কিছুই। দ্বিতীয়ার্ধের গোলটি আরো দেখার মতো। ৬২ মিনিটের সময় মাঝ মাঠ থেকে বল পেয়ে একাই ছুটলেন মেসি। সামনে আর্জেন্টিনার কেউ ছিলো না। তাকে আটকাতে রক্ষণভাগের অন্তত তিনজন চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু মেসিও সব বাধা টপকে ছুটতে থাকেন। সামনে তাকিয়ে দেখলেন গোলরক্ষকও এগিয়ে এসেছেন। আর যায় কোথায় দূর থেকেই বল তুলে দিলেন গোলরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে। বল ফাঁকা রাস্তা পেয়ে চুম্বন খায় জালে।
আর্জেন্টিনার জয়ে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন চূর্ণ হলো চিলির। তারা ২৬ পয়েন্ট নিয়ে ছিল ৩ নম্বরে। কিন্তু ব্রাজিলের কাছে হেরে তারা একই পয়েন্টে আছে। গতকালের জয়ে আর্র্জেন্টিনার পয়েন্ট হয়েছে ২৮। আর ২৬ পয়েন্ট নিয়ে চারে থাকা কলম্বিয়া পেরুর সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করেছে। এতে ২৭ পয়েন্ট নিয়ে তারা পেয়ে গেছে বিশ্বকাপের টিকিট। এখন পেরুর পয়েন্ট চিলির সমান ২৬ হলেও গোল ব্যবধানে এগিয়ে তারা। ফলে আশা জিইয়ে রইলো। পেরুকে এখন ওশেনিয়া অঞ্চলের চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্লে-অফ খেলতে হবে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে নিশ্চিত হলো ব্রাজিল, উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও কলম্বিয়া।
ব্রাজিল চিলিকে কোনো ছাড়ই দেয়নি। গত দুই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের কাছে হেরেই শেষ ১৬ থেকে বিদায় নেয় চিলি। এবার তাদের কাছে হেরেই বিদায় হলো বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব থেকেই। ব্রাজিলের ৩-০ গোলের জয়ে দুটি গোল করেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। তিনটি গোলই হয় দ্বিতীয়ার্ধে। ৫৫ মিনিটের সময় প্রথম গোল করেন পওলিনহো। এতে বাছাই পর্বে তাদের পয়েন্ট হলো ৪১ যা ওই অঞ্চলের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০০২ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে আর্জেন্টিনার ৪৩ পয়েন্ট এখনো সর্বোচ্চ।
আজ উরুগুয়ে ৪-২ গোলে হারায় বলিভিয়াকে। এতে দুটি গোল করেন মেসিরই বার্সেলোনা-সতীর্থ লুইস সুয়ারেজ। বাছাইপর্বে তার গোল দাঁড়ালো ১৮। এনিয়ে ১৩ বার বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলবে উরুগুয়ে।