ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। উত্তর প্রদেশ সরকার জানিয়েছে, রাজ্যজুড়ে আইন ও শৃঙ্খলার উন্নয়ন ঘটাতে ৪৩৩টি ‘পুলিশ এনকাউন্টারের’ ঘটনা ঘটেছে। অপরাধীদের সঙ্গে লড়াইয়ে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি ছুড়ে হত্যা করার ঘটনাকে বর্ণনা করতে ‘এনকাউন্টার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ভারতে এটি বেশ জনপ্রিয় একটি শব্দ। তবে বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব এনকাউন্টারের বেশিরভাগই সাজানো বলে দাবি করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উত্তর প্রদেশের এক সরকারি কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, রাজ্যে অপরাধের হার বেড়ে যাওয়ায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এই (এনকাউন্টার) অভিযান শুরু করেন। সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, উল্লিখিত ৪৩৩টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে গত ৬ মাসের মধ্যে। আদিত্যনাথ ভারতের ডানপন্থি ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পক্ষ থেকে মার্চ মাসে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। তখন থেকেই এসব এনকাউন্টার শুরু হয়। একটি সরকারি প্রেস-রিলিজে এসব এনকাউন্টারকে সরকারের ‘অর্জন’ বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটার প্রমাণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তবে এনকাউন্টারের এই বিশাল সংখ্যা অনেকের মনে প্রশ্নও জাগিয়েছে।
উত্তর প্রদেশে ২২ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। এটি ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য। রাজনৈতিকভাবে এর গুরুত্ব ব্যাপক। ভারতের পার্লামেন্টে শুধু এ রাজ্য থেকেই নির্ধারণ করা হয় ৮০ জন এমপিকে। তবে, খবরে এই রাজ্যটির নাম বেশিরভাগ সময়ই আসে নৃশংস সহিংসতা, বিক্ষোভ ও ধর্ষণের ঘটনা ঘিরে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় বিজেপি উত্তর প্রদেশে অপরাধের হার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অনেকের মতে, রাজ্যটির প্রধান সমস্যাগুলোর একটি। আর বিজেপি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর এ সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। শুধু এই বছরের জানুয়ারি মাস থেকে আগস্ট মাসের মধ্যেই ৩ হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। রাজ্যের ক্রাইম রেকর্ড অনুসারে, গত বছর একই সময়ের মধ্যে এ সংখ্যা ছিলো ২ হাজার ৩৭৬টি। হত্যাকাণ্ডের হার অবশ্য গত বছরের তুলনায় এ বছর কিছুটা কমেছে। তবে ব্যাপক আকারে বেড়েছে বিক্ষোভ ও ডাকাতির ঘটনা। দলিত ও নারীঘটিত অপরাধসহ বড় ধরনের অপরাধগুলোর সংখ্যা বেড়েছে তুলনামূলকভাবে। জনসম্মুখে নারীদের যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা করতে পুলিশ সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে আদিত্যনাথের ‘এন্টি-রোমিও’ বাহিনী। তবে তা সত্ত্বেও জনসম্মুখে নারীদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, অপরাধের হার বৃদ্ধি হওয়ার বিষয়টিই আদিত্যনাথকে এমন পদক্ষেপ নিতে উদ্ধুদ্ধ করেছিল। তাদের ভাষ্যমতে, আদিত্যনাথ ক্ষমতায় আসার পর দ্রুতই বুঝতে পেরেছিলেন যে, শুধু মামুলি মন্তব্য দিয়ে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটানো যাবে না। শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও রাজ্যে ক্রমবর্ধমান অপরাধের ঘটনা সামলানোর একটি কৌশল বের করার চেষ্টা করছিলেন। তবে তারা এমন কোনো কৌশল বের করতে পারার আগে আদিত্যনাথ নিজেই একটি সমাধান খুঁজে বের করে ফেললেন- সেই সমাধানের সঙ্গে জড়িত ছিল এনকাউন্টার। তার বিশ্বাস ছিল এমনটি হলে তার সরকার প্রয়োজনীয় গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারবে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী (১৯৮৯-৯০) বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। তিনিও আদিত্যনাথের মতো ডাকাতদের বিরুদ্ধে এরকম বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযান শুরু করেছিলেন। একসময় তাকে কঠোর সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করতে হয়। ৪৫ বছর বয়সী আদিত্যনাথও কম সমালোচনার শিকার হননি। এই হিন্দু সন্ন্যাসী পাঁচবার নির্বাচিত হয়েছেন এমপি হিসেবে। ভারতের সবচেয়ে বিভেদমূলক রাজনীতিবিদদের একজন হিসেবে ধরা হয় তাকে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ভাষণ দিয়ে প্রায়ই সমালোচনার শিকার হয়েছেন তিনি। বিশেষ করে তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় এমন ভাষণের জন্য ব্যাপক আকারে নিন্দিত হয়েছেন এই মুখ্যমন্ত্রী।
উত্তর প্রদেশজুড়ে এই বিচারবহিরর্ভূত পুলিশি-হত্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দিল্লিও। বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার জানিয়েছে, এসব হত্যাকাণ্ড ২০১৯ সালের নির্বাচনে দলের বিপক্ষে কাজ করতে পারে। শীর্ষ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকর্তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কেন এসব হত্যাকাণ্ড সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারেনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণ পুলিশকর্মী বিবিসিকে এ বিষয়ে বলেন, এসব এনকাউন্টার পুলিশের অবস্থানই কিছুটা ভালো করতে পেরেছে। কিন্তু সরকারকে গ্রহণযোগ্যতা এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি, এসব এনকাউন্টারের কারণে রাজ্যের বাকি প্রতিষ্ঠিত আইনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা জানান, আদিত্যনাথ যখন বুঝতে পারলেন যে, তার সরকারকে এই ৪৩৩টি হত্যাকাণ্ডের প্রত্যেকটির জন্য দায়ী করা হবে তখন এনিকাউন্টার শব্দটির অর্থই পাল্টে দিলো। তারা দাবি করলো, প্রত্যেক এনকাউন্টার মানেই যে কেউ খুন হয়েছে এমন নয়। একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এই ৪৩৩টি এনকাউন্টার এটাও বোঝায় যে, পুলিশ এতবার অপরাধীদের মোকাবিলা করেছে। শুধু সেসব অপরাধীকেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, যারা পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করেছে বা আগে গুলি ছুড়ে পালানোর চেষ্টা করেছে। তারা সবশেষে জানায়, পুরো রাজ্যজুড়ে এই ৪৩৩টি এনকাউন্টারে খুন হয়েছে মাত্র ১৯ জন অপরাধী। আর আহত হয়েছে ৮৯ জন। সরকারি রেকর্ড অনুসারে, এসব এনকাউন্টারে অপরাধীদের পাশাপাশি ১ জন পুলিশকর্মীও নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ৯৮ পুলিশকর্মী। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে এসব দাবি উত্তর প্রদেশ সরকারকে সাহায্য করবে কি না তা এখন একমাত্র সময়ই বলতে পারবে।