এক মুখোশপরা সেনা ধীরে ধীরে তার রুক্ষ, নোংরা হাত দিয়ে আদিজাকে সপর্শ করলো- তার কাপড় ছিঁড়ে ফেললো। আদিজা চিৎকার করে উঠলো, তাকে লাথি দিয়ে সরানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারেনি। এক হাতে বন্দুক ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে নিজের কাপড় খোলা শুরু করলো ওই সেনা। আদিজা কাঁদতে কাঁদতে তাকে থামার আবেদন জানিয়ে গেলো। কিন্তু সে থামেনি।হত্যা করার ভয় দেখিয়ে সে ধর্ষণ করে ১৩ বছর বয়সী আদিজাকে। ওই সেনার কাছে ধর্ষিত হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই রাখাইনের এক গ্রামে নিজের বাড়িতে এক টেবিলের নিচে থেকে নিজের বাবা-মাকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখতে হয়েছে তাকে। আদিজা সেখান থেকে জঙ্গলে পালানোর চেষ্টা করলে এক সেনা তাকে ধরে ফেলে। আদিজা বলেছে, ‘সে যখন আমার ওপর পাশবিকতা চালায় তখন আমি শুধু একটি বিষয়ই ভাবছিলাম- আমি আমার কুমারিত্ব হারাচ্ছি। আমি আর পবিত্র নই। আমি দূষিত হয়ে গেছি। আমায় আর কেউ বিয়ে করবে না।’ কয়েক দিন আগে আদিজা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত কাওরাবি গ্রামে তার বাবা-মা’র সঙ্গে থাকতো। আদিজা জানায়, সাত সপ্তাহ আগে সেই গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। অনেক গ্রামবাসী প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। তাদের সঙ্গে মিলে আদিজা ও তার বোনও সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আদিজার মতো এমন হাজারো রোহিঙ্গা শিশু রাখাইন ছেড়ে ২৫শে আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। অনেকেই বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজন হারিয়ে সর্বহারা হয়ে দিনাতিপাত করছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে। তবে পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, নিরাপত্তার খোঁজে মিয়ানমারের অত্যাচার থেকে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গা শিশু এখানেও নিরাপদ নেই। রোহিঙ্গা শিবিরেও তারা শিকার হচ্ছে যৌন নির্যাতনের। বার্তা সংস্থা রয়টার্সে সমপ্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন কথা বলা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল আসা শুরুর পর থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে ৮০০ এর বেশি লিঙ্গ-ভিত্তিক নির্যাতনের ঘটনার খোঁজ পেয়েছে ইউনিসেফ। এ তথ্য দিয়েছেন ইউনিসেফের শিশু অধিকার রক্ষা বিষয়ক প্রধান জিন লিয়েবি। ইউনিসেফের দেয়া তথ্য অনুসারে, ওইসব ঘটনার অর্ধেকের বেশিই হচ্ছে যৌন হামলা সম্পর্কিত। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২৫শে আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আনুমানিক ৫ লাখ ৮৬ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে মিয়ানমার থেকে। সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক অভিযানের নামে নৃশংস নির্যাতন চালাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। জাতিসংঘে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এমন অভিযানকে জাতি নিধনের পরিষ্কার উদাহরণ বলে আখ্যায়িত করেছে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন আগত রোহিঙ্গাদের ৬০ শতাংশই হচ্ছে শিশু। আদিজা তার ১৫ বছর বয়সী বোনের সঙ্গে বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় এক মাস আগে। তবে এখানে এসেও নিরাপদ বোধ করে না তারা। আদিজার বোন মিনারা এ বিষয়ে বলেছে, আমাদের বাবা-মা ও দুই বড় বোনকে হত্যা করে ফেলেছে। তারা আর আমাদের দেখভাল করতে পারবে না। এইখানে (বাংলাদেশে) এই শিবিরে আমরা সম্প্রতি অন্যান্য মেয়েদের ধর্ষণ হওয়ার কথা শুনেছি। এজন্য আমরা বেশিরভাগ সময় আমাদের তাঁবুর ভেতরেই থাকার চেষ্টা করি।
মানসিক আঘাত
শিবিরে বেশ কিছু স্কুল রয়েছে। সেগুলোর একটি খালি শ্রেণিকক্ষে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয় রোহিঙ্গা মেয়ে শিশু-কিশোরীরা। তবে শর্ত ছিল যে, শ্রেণিকক্ষের জানালা বন্ধ রাখতে হবে। পাশাপাশি তাদেরকে পুরো নাম ধরে না ডাকতেও নিষেধ করে তারা। তারা তাদের মুখ তাদের কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। এমনকি কোনো পুরুষ যাতে এই কক্ষে না ঢুকতে পারে সে বিষয়েও নিশ্চয়তা চাচ্ছিল তারা। আদিজার বড় বোন মিনারা রাখাইন থেকে পালিয়ে আসার সময় ধর্ষণের শিকার হয়। সে বলে, আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা নিয়ে আমি লজ্জিত। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আমার কুমারিত্বের সঙ্গে সবকিছু হারিয়ে গেছে। মিনারা সাক্ষাৎকারের সময় তার এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করা কালো রংয়ের একটি সেলাই করা কাপড় পরিহিত ছিল। ওই কাপড়ে ধীরে ধীরে আঙুল ঘোরাতে ঘোরাতে ভয়াতুর কণ্ঠে মিনারা বলে চলে, আমি নিজকে সম্পূর্ণরূপে ঢেকে রাখতে চাই। কিন্তু সে কাপড়ও আমার নেই। ত্রাণ সংস্থাগুলো শিবিরে নিরাপদ অল্পকিছু আশ্রয় স্থাপন করেছে। যেখানে নারী ও শিশুরা যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি থেকে নিরাপদে থাকবে। ইউএনএফপিএ-র মুখপাত্র ভেরোনিকা পেদ্রোসা বলেন, তারা এখানে নিরাপদ বোধ করে। তারা জানে যে এখানকার মানুষগুলো তাদের অনুভূতি বুঝবে ও প্রথমবারের মতো তাদের ওপর চালানো নির্যাতনের কথা খুলে বলে। তবে এত বিশাল সংখ্যার মানুষের মধ্যে সবার জন্য এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণের জায়গা নেই। ইউনিসেফের লিয়েবি বলেন, বাংলাদেশ এর আগে কখনো এত বিশাল সংখ্যার শরণার্থী ঢল দেখেনি। আমরা এখন রোহিঙ্গা শিশু শরণার্থীদের প্রয়োজন পূরণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
কলঙ্কের কালি
ত্রাণ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিবিরে বেশ কিছু কাউন্সেলিং সেবা চালু রয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও অনেক শিশু-কিশোরীই তাদের ধর্ষণের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাতে চায় না। যৌন নির্যাতন নিয়ে কাজ করা এক নার্স রেবেক্বা ডাস্কিন বলেন, এ ধরনের পরিবেশে মেয়েরা সাধারণত কলঙ্কিত হওয়ার ভয়ে থাকে। তাদের পরিবারের সদস্যরা তাদের কী বলবে তা নিয়েও একধরনের ভীতি কাজ করে। তিনি বলেন, বেশিরভাগ ধর্ষিতাই একের অধিকবার ধর্ষিত হয়েছেন। তাদের এখন একটি নিরাপদ আশ্রয়ের দরকার। তারা সংঘর্ষ-আক্রান্ত অঞ্চলে নৃশংসভাবে ধর্ষিত হয়েছে। আবার মাঝে মাঝে জনসম্মুখেও। এতে তাদের মানসিক আঘাতের পরিমাণ বেড়েই চলছে। রোহিঙ্গা শিবিরে আগত রোহিঙ্গারা ক্ষুধার্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায় বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। কেউ কেউ শারীরিকভাবে আহত অবস্থায়ও এসেছে। তবে এর চেয়ে বেশি গভীর হচ্ছে এই মানসিক আঘাত। মিনারা বলেন, আমি আবার রাখাইনে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে এখানে মরতে রাজি আছি। আমরা খুব কম বাইরে যাই। এখানে কোনো বন্দুক নেই। কিন্তু এখানেও আমাদের ধর্ষণ করার মতো মানুষ রয়েছে। তার সঙ্গে একমত পোষণ করে আদিজা। সে বলে, সেনারা যখন আমাদের জংলে নিয়ে যাচ্ছিল আমি ভেবেছিলাম আমরা মারা যাবো। তবে এখন আমার মনে হয়, সেসময় মরে গেলে ভালো হতো। নিজের পবিত্রতা হারানোর চেয়ে তা বেশি ভালো।