মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহীম, সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ ক্রিকেটের তিন অধিনায়ক সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম নিয়ে মুগ্ধ। সিলেটে বিপিএলের খেলা নিয়ে যতটা কথা হয়েছে তার চেয়ে বেশি আলোচনায় এ স্টেডিয়ামের সৌন্দর্য্য। কতটা সুন্দর! জবাবে এক বাক্যে সবাই জানিয়ে দেন- ‘দেশ সেরা এটি’। লাক্কাতুরা চা বাগান ও চার পাশে সবুজ পাহাড়ের কোলে লাল টালির ছাদে সাজানো সাদা ভবন। সবুজের মাঝে লাল-সাদার অপরূপ মেলবন্ধন দেশের আর কোনো স্টেডিয়ামে নেই। কিন্তু যার কল্পনার নকশার উপর বাস্তবের এ রূপ সেই স্থপতি (আর্কিটেক্ট) মাসুদুর রহমান খান অনেকটাই অতৃপ্ত।কারণ তার কল্পনার অনেকটাই এখানে শেষ পর্যন্ত পূর্ণতা পায়নি। তড়িঘড়ি কাজ করতে গিয়ে ডিজাইনের সঙ্গে অনেক কিছুরই অমিল হয়েছে। এখনো অনেক কিছু বাকি যা পরিপূর্ণতা দেবে এ স্টেডিয়ামকে। তবে প্রকৃতির যে রূপকে এরই মধ্যে ধ্বংস করা হয়েছে তা আর ফিরে পাবে না বলে আক্ষেপে পুড়ছেন মাসুদুর রহামান।
দৈনিক মানবজমিন-এর স্পোর্টস রিপোর্টার ইশতিয়াক পারভেজের সঙ্গে কথোপকথনে তার সেই স্বপ্ন ও আক্ষেপের কথা তুলে ধরেন অকপটে। তার মূল অংশ তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: আপনার নকশাতেই সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম- কতটা গর্বিত?
মাসুদুর রহমান: ভালো লাগে এমন একটি স্টেডিয়ামের নকশা করতে পেরেছি। যখন এ স্টেডিয়াম নিয়ে আলোচনা হয় তখন গর্ববোধ করি।
প্রশ্ন: আপনার নকশায় কোন বিষয়টাকে প্রাধান্য দিয়েছেন?
মাসুদুর: আমি যখন স্টেডিয়ামের নকশার কাজ শুরু করি তার আগে সিলেটে আসি। এ অঞ্চলটা ভালোভাবে ঘুরে দেখেছি। আমার মাথায় ছিল এখানকার ঐতিহ্যের সঙ্গে কী মিল রাখা যায়। তখন দেখেছি এখানে চা বাগানের বাংলোগুলো, আর পুরনো-নতুন অনেক বাড়িতে এমন টিনের চাল, যেগুলোর রঙ লাল। সেখান থেকেই আমার মাথায় আসে এমনটা বাংলাদেশের কোথাও নেই। এমন ডিজাইন দেখতে পাওয়া যায় দেশের বাইরে। মূলত আমার নকশাতে প্রাধান্য পেয়েছে ঐতিহ্য ও সিলেটের সবুজ প্রকৃতি।
প্রশ্ন: আপনার নকশাতে কী কী ছিল?
মাসুদুর: আমার পরিকল্পনার মধ্যে যে শেপটা করা হয়েছে সেটার নিচ থেকে আমাদের কিছু হসপিটালিটি বক্স। উপরে যারা গ্যালারিতে বসবে তাদের জন্য পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা। একদম নিচে না গিয়েও যেন টয়লেট ব্যবহার করতে পারে সেটা রাখা হয়েছে। এই ক্লাসিফিকেশনটা নিয়ে ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে কথা বলেছি। অলরেডি একটা প্রপোজাল দিয়ে রেখেছি। এখন যে গ্যালারি হয়েছে তার উপর তাঁবুর ডিজাইন করা হয়েছে। এছাড়াও গ্রিন গ্যালারিতে এখনো অনেক কাজ বাকি। যেমন সেখানে টয়লেট রাখতে হবে। কিছু খাবার দোকান করতে হবে।
প্রশ্ন: আপনার ডিজাইনের কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে?
মাসুদুর রহমান: দেখেন আমরা যখন নকশা করি তখন অনেক কিছু কল্পনায় থাকে, সেখান থেকে একটি মূল ড্রইং করা হয়। সেখানে ছোট ছোট অনেক বিষয় থাকে। কিন্তু যারা এ নকশা নিয়ে কাজ করে তারা অনেক সময় সবটা বাস্তবে রূপ দিতে পারেন না। এখানেও যারা ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছে তারা অনেক কিছুই করতে পারেনি। এছাড়াও ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে ঘিরে অনেক তড়িঘড়ি ছিল। তাতেও অনেক কিছু নকশার শত ভাগ ঠিক রেখে করা হয়নি। এছাড়াও আমার নকশাতে স্টেডিয়ামের পিছনে পাহাড় ছিল। কিন্তু খুব বাজেভাবে সেই পাহাড়টা কেটে ফেলা হয়েছে। তাতে আমি রীতিমতো হতাশ।
প্রশ্ন: পাহাড় কেটে ফেলায় স্টেডিয়ামের সৌন্দর্য্যের উপর কতটা প্রভাব পড়েছে?
মাসুদুর: পেছনের যে পাহাড়টা কেটে ফেলা হয়েছে তাতে আমি খুব বিরক্ত হয়েছি। খারাপ লাগছে। মিডিয়া সেন্টারের পিছনে একটা উঁচু পাহাড় ছিল। মাঠে বসে পাহাড়টা দেখা যেত। আমাকে জানালে আমি কোনোভাবেই এটাকে কাটতে দিতাম না। কিছু কিছু কাজ হুটহাট করে ফেললে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করে। এটা ঠিক হয়নি। কনসেপ্ট ছিল সিলেটের চা বাগান, পাহাড়ের সবুজ। সেটাই যদি না থাকে তাহলে ক্ষতিতো হয়ে যায়। কারণ সিলেটের সবুজই তো আসল। আর পাহাড় না থাকাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মুখে থাকবে এ স্টেডিয়াম। এছাড়াও দেখবেন দোতলা যে গ্যালারিটা আছে তার উপর তাঁবুর মতো ডিজাইন করা। সেখানে লাইট ছিল। কিন্তু তাও রাখা হয়নি। যদি লাইট থাকতো সেটি রাতে জ্বলে থাকতো। অনেক দূর থেকে স্টেডিয়ামটি রাতে অন্যরূপে দেখা যেত। এছাড়াও এ তাঁবুটি আসলে লাইট সেড হিসেবেও আমার নকশাতে রাখা ছিল। কিন্তু তা রাখা হয়নি।
প্রশ্ন: গ্রীন গ্যালারি কতটা বাস্তবে রূপ নিয়েছে?
মাসুদুর: আসলে অন্যান্য দেশের গ্রীন গ্যালারির মতো এটি হয়নি। এখানো অনেক কাজ বাকি। অলরেডি মন্ত্রণালয়ে একটা প্রপোজাল দেয়া আছে। নতুন কিছু নকশায় যোগ করেছি। এখন তারা কবে কাজে হাত দেবে- সেটাই দেখার বিষয়!
প্রশ্ন: বাংলাদেশের অন্য কোনো স্টেডিয়ামের নকশার কাজ করেছেন?
মাসুদুর: মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টারের উপরে তাঁবুর ডিজাইন আমার করা। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের নতুনভাবে যে সংস্কার কাজ হয়েছে সেটাও আমার করা। এখন সিলেটের কিছু কাজের নতুন নকশা করে দিয়েছি। চেষ্টা করবো সিলেটের প্রকৃতি ও সবুজকে প্রাধান্য দিয়ে যতটা সম্ভব কাজ করার। কারণ প্রকৃতির রূপের প্রভাবটা অনেক বড় একটা বিষয়। আশা করি সিলেটের আর পাহাড় কেটে এর সৌন্দর্য্য নষ্ট করা হবে না।