কূটনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে মিয়ানমার সফর শুরু করেছেন ষষ্ঠ পোপ ফ্রাঁসিস। রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সঙ্গে সেদেশের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা নিয়ে বিশ্ববাসী যখন ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন, ঠিক তখনই তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলেন পোপ। তিনিই এখন মিয়ানমার সফরে, যেখানে মুখ দিয়ে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করায় নিষেধাজ্ঞা আছে। আজ সোমবার তার সফরকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে সমবেত হয়েছেন হাজার হাজার ক্যাথলিক খ্রিস্টান। বাস, ট্রেনÑ যে যেভাবে পারেন তারা এক নজর পোপ ফ্রাঁসিসকে নিজের চোখে দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছেন ইয়াঙ্গুনে। মিয়ানমারের সবেচেয়ে বড় শহর এটি। পোপ ফ্রাঁসিসের সফরকে কেন্দ্র করে এখানে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক দাঙ্গা পুলিশ। স্থানীয় সময় দুপুর এক টা ১৫ মিনিটে অবতরণ করার কথা রয়েছে পোপের। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেখানে কোনো বিক্ষোভ, প্রতিবাদ দেখা যায় নি। তার এ সফর উপলক্ষ্যে ইয়াঙ্গুনে ব্যাপক জনসমাবেশের আয়োজন করেছে স্থানীয় ক্যাথলিক মিয়ানমার চার্চ। এর মুখপাত্র মারিয়ানো সোয়ে নাইং বলেছেন, তাতে যোগ দিতে স্বাক্ষর করেছেন কমপক্ষে দেড় লাখ মানুষ। তার এই সফরের দিকে চোখ বিশ্ববাসীর। তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির সঙ্গে বৈঠকে কতদূর অগ্রসর হতে পারবেন, বিশ্ববাসী সেদিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তিনি যদি বৈঠকে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেন তাহলেই বিভ্রাট বেধে যেতে পারে। ঝুঁকিতে পড়তে পারেন মিয়ানমারে বসবাসরত বিপুল সংখ্যাক খ্রিস্টান। তাই সফরের আগেই তাকে তার উপদেষ্টারা পরামর্শ দিয়েছেন। তারা তাকে হুঁশিয়ার করেছেন যাতে তিনি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ না করেন। বলা হয়েছে, যদি তিনি এই শব্দটি উচ্চারণ করেন তাহলে কূটনৈতিক টানাপড়েন দেখা দিতে পারে। এর শিকার হতে পারেন সংখ্যালঘু খ্রিস্টানরা। বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকার তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। কিন্তু এসব কিছুকে পিছনে ফেলে পোপকে স্বাগত জানাতে, তাকে নিজের চোখে দেখার জন্য খ্রিস্টানরা জমায়েত হয়েছেন। এ সম্প্রদায়ের নেতা উইন উইন সেট বলেছেন, দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো থেকে তিনি ১৮০০ ক্যাথলিক খ্রিস্টানকে ইয়াঙ্গুনে নিয়ে এসেছেন। তারা ‘পবিত্র ফাদার’কে দেখতে চান। তিনি বলেন, এমন সুযোগ কয়েকশত বছরে একবার আসে। যখন রাজনৈতিক ইস্যু সামনে আসে তা কিভাবে মোকাবিলা করতে হয় তা ভাল করে জানেন পোপ। তাই তিনি স্মার্টলি সব ইস্যু নিয়ে কাজ করবেন। উল্লেখ্য, ২৫ শে আগস্ট রাখাইনে সহিংসতার পর রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেদেশের সেনাবাহিনী নৃশংস নির্যাতন চালায়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে তারা। এর ফলে বাধ্য হয়ে কমপক্ষে ৬ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতাকে জাতি নিধন বলে অভিহিত করেছেন। এর আগেই জাতিসংঘ একে একই নামে অভিহিত করে। রেক্স টিলারসন ভয়াবহ এই নৃশংসতার জন্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে টার্গেটেড অবরোধ দেয়ার কথা বলেন। ওদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা রাখাইন রাজ্যে ধারাবাহিকভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নির্যাতনের শিকার। তাদেরকে যুগের পর যুগ ধরে দেশের নাগরিকের খাতার বাইরে রাখা হয়েছে। দু’ বছর ধরে দেশটির সেনাবাহিনী তাদের ওপর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। এর মধ্যে রয়েছে হত্যা, ধর্সণ, নির্যাতন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা। এসব অভিযোগের বেশির ভাগই অস্বীকার করে মিয়ানমার সরকার। দেশটির সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক এসব অভিযোগ নিয়ে নিজেদের মতো করে তদন্ত করেছে। তারপর বলেছে, তাদের সেনা সদস্যদের দ্বারা কোনো অন্যায়ের প্রমাণ তারা পায় নি। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদেরকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না মিয়ানমার। এমনকি তাদেরকে মিয়ানমারের কোনো জাতি হিসেবেও স্বীকার করে না। তারা রোহিঙ্গাদেরকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দে অভিহিত করে না। মিয়ানমারের বেশির ভাগ মানুষ রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে দেখে বাঙালি হিসেবে। তাদের দাবি, এরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। এরা হলো বাংলাদেশী। বাংলাদেশ থেকে সেখানে যেয়ে তারা অবৈধভাবে অবস্থান করছে। এ বিষয়টিই পোপ ফ্রাঁসিসের জন্য উভয় সঙ্কট। তিনি কি ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার পক্ষে কথা বলবেন নাকি প্রায় সাত লাখ রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের কথা ভেবে মুখ বন্ধ করে রাখবেন! যদি তিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কথা বলেন, উচ্চারণ করেন রোহিঙ্গা শব্দ তাহলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আর তাতে ঝুঁকিতে পড়তে পারে সেখানে বসবাসরত খ্রিস্টানরা। আবার যদি তিনি খ্রিস্টানদের কথা চিন্তা করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে কথা না বলেন, তাহলে বিশ্ব দরবারে পর্যবেক্ষকদের সামনে কি বলবেন! এসব নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তিনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন। পরে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ দুটি বৈঠককে সবচেয়ে উত্তেজনাকর মুহূর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। পোপ ফ্রাঁসিসের এই সফর স্থায়ী হবে ২রা ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর শেষের দিকে তার বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। এ সময় তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন।