রায়হান কবির,স্বদেশ নিউজ ২৪.কমঃ ২৬ বছর ধরে অনির্বাচিত উপাচার্যরা চালাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়। রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন হয় না ২৮ বছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ছাত্রদেরও নেই কোনো প্রতিনিধিত্ব। ফলে কার্যত কোনো জবাবদিহি নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। এখানে উপাচার্যই শেষ কথা।
এই চিত্র ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একটি বিভাগের একজন অধ্যাপক আক্ষেপ করে বলেন, নব্বই সালের পর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় অগণতান্ত্রিক চর্চা। সেই যে উল্টো পথে যাত্রা হলো, তা এখনো চলছেই।
অনুসন্ধানেও এই অধ্যাপকের কথার সত্যতা মিলল। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১৯৯১ সাল থেকে গত ২৬ বছরে পূর্ণ ও ভারপ্রাপ্ত মিলিয়ে নয়জন অধ্যাপক উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু কেউ উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দেননি। সবাই সরকারের নির্বাহী আদেশে দায়িত্বে পেয়ে নানা কৌশলে সময় পার করেছেন। অবশ্য কেউ কেউ প্রথম চার বছরের শেষবেলায় এসে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের চেষ্টা করেছেন বটে, তবে সেটা দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হওয়ায় আশায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচন আর হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক প্রথম আলোকে বললেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশটি এখন অকার্যকর। যিনিই উপাচার্য হয়ে আসেন, তিনিই অধ্যাদেশটি পদদলিত করছেন নিজের সুবিধায়। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর কোনো জবাবদিহি নেই।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনসহ বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সবার চেয়ে পিছিয়ে। কোনো উপাচার্যই জট খোলার চেষ্টা করেননি। এখন তো যাঁরা তদবির করতে পারছেন, তাঁরাই উপাচার্য হচ্ছেন। উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন ও রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন আটকে রাখা হয়েছে, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন শিক্ষার্থী প্রায় ২৪ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয়টি চলার কথা ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের মাধ্যমে।
’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী উপাচার্য নিয়োগের প্রথম নিয়মটি হলো সিনেট মনোনীত তিনজনের প্যানেল থেকে একজনকে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন আচার্য তথা রাষ্ট্রপতি। কিন্তু এটি না করে বিকল্প হিসেবে সরাসরি উপাচার্য নিয়োগ করা হচ্ছে। নিয়মানুযায়ী যাঁরা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তাঁদের পরে প্যানেল নির্বাচন দেওয়ার কথা। কিন্তু মামলাসহ নানা কায়দায় আর সিনেট নির্বাচন দেওয়া হয় না।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন নির্বাচিত উপাচার্য হয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম নির্বাচিত উপাচার্য হন মোহাম্মদ আলী। ১৯৮৮ সালে তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিলে ইতিহাসের অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনকে অস্থায়ী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ১৯৮৯ সালে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দিয়ে সর্বোচ্চ ভোট পান এবং নির্বাচিত প্যানেল থেকে তাঁকে উপাচার্য করা হয়। কিন্তু ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর অধ্যাপক সিরাজুদ্দীনকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সরিয়ে দেয়। তিনিই এই বিশ্ববিদ্যালয়টির সর্বশেষ নির্বাচিত উপাচার্য। এরপর একে একে নয়জন অধ্যাপক অনির্বাচিত হিসেবে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা হলেন রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল মান্নান, মোহাম্মদ ফজলি হোসেন, এ জে এম নূরুউদ্দীন চৌধুরী, এম বদিউল আলম, আবু ইউসুফ, মো. আলাউদ্দিন (ভারপ্রাপ্ত), আনোয়ারুল আজিম আরিফ ও বর্তমান উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। সরেজমিনে জানা গেল, বর্তমান উপাচার্যও নির্বাচন দেওয়ার মতো কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেননি।
অবশ্য বর্তমান উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই নতুন গ্র্যাজুয়েট নিবন্ধনের কাজ শুরু করবেন। এরপর রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচনসহ সিনেটে অন্যান্য প্রতিনিধির পদগুলো পূরণ করে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দেওয়া যাবে বলে তিনি আশাবাদী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, সব শ্রেণির প্রতিনিধি থাকা সিনেটের মাধ্যমে যখন উপাচার্য হন, তখন জবাবদিহি থাকে। কিন্তু বর্তমানে তা নেই। এখন অনির্বাচিত উপাচার্যরা এসেই নিজের পছন্দের লোককে বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন। বর্তমান উপাচার্যও নির্ধারিত কয়েকজন ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করছেন বলে একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেছেন। শিক্ষক সমিতি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফোরামেও বর্তমান প্রশাসনের পছন্দের ব্যক্তিদের বসানো হচ্ছে। ফলে কোনো ভারসাম্য থাকছে না। এ নিয়ে সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে। সদ্য অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটে চারটি শ্রেণির শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। রোববারের ওই নির্বাচনে দুটি পদে সরকার সমর্থকেরা পরাজিত হয়েছেন। দ্বন্দ্বের কারণে আরেকটি পদে সরকার সমর্থকদের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী জিতেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি উপাচার্য থাকাকালে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, তফসিলও ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু মামলার কারণে পারেননি। তিনি মনে করেন, অবশ্যই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হওয়া উচিত।
রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচন হয় না ২৮ বছর
১০১ সদস্যের সিনেটে ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি থাকার কথা, যাঁদের মেয়াদ তিন বছর। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন হয়েছিল। সে হিসাবে ১৯৮৯ সালে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও আর হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশে বলা হয়েছে, পরবর্তী প্রতিনিধি না আসা পর্যন্ত আগের নির্বাচিতরাই থাকবেন। কিন্তু তিন বছর মেয়াদের জন্য এসে বছরের পর বছর ধরে এভাবে থাকতে বিব্রত সর্বশেষ নির্বাচিত রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটরাই। ওই সময়ে নির্বাচিত কয়েকজন ইতিমধ্যে মারাও গেছেন। সর্বশেষ নির্বাচিতদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অধ্যাপক এম আবদুল গফুর প্রথম আলোকে বলেন, এই নির্বাচন নিয়মিত হওয়া উচিত। কারণ, প্রতিবছর হাজার হাজার রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকছে না, এটা কাম্য নয়।
১৯৯০ সালের পরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আর না হওয়ায় ছাত্রদেরও কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজেদের বিবেকের কাছে জবাবদিহি থাকার কথা, কিন্তু দুঃখজনক হলো ১৯৯১ সালের পর থেকে এটাকে আমরাই আর ধরে রাখতে পারিনি।’
অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে নানা কথা
বর্তমান উপাচার্যের আমলে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগ কম হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বেশি হয়েছে। কেবল গত জুনেই একসঙ্গে ৬৮ জন কর্মচারীকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁদের অধিকাংশের বাড়ি চট্টগ্রামে, বিশেষ করে হাটহাজারী এলাকার। প্রথম আলোর কাছে ওই সব ব্যক্তির বেশ কিছু নিয়োগপত্র এসেছে। সেগুলোর মধ্যে ২০টি নিয়োগপত্র যাচাই করে দেখা যায়, ১৬ জনের বাড়িই হাটহাজারী থানার অধীন। নাম প্রকাশে একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছাড়াও নিয়োগ হয়েছে। এ নিয়োগ নিয়ে ক্যাম্পাসে নানা কথা চালু হয়েছে। অবশ্য উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজনেই কমিটির মাধ্যমে অ্যাডহক ভিত্তিতে কিছু নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানে পরীক্ষাই প্রথম যোগ্যতা। আঞ্চলিকতা বলতে কিছু নেই।
জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই একেবারে জরুরি না হলে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়া অনুচিত।