নির্বাচনী বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কায় দুই মাস আগেই বিনামূল্যের বই ছাপার কাজ শেষ করতে চায় সরকার। এজন্য বই ছাপার সব প্রক্রিয়া এগিয়ে আনা হয়েছে। ৩০শে ডিসেম্বরের পরিবর্তে আগামী ৩০শে অক্টোবরের মধ্যে বিনামূল্যের সব বই ছাপিয়ে উপজেলায় পৌঁছানো হবে। এজন্য বিভিন্ন টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে বাকি সব টেন্ডার শেষ হয়ে যাবে। প্রাথমিক স্তরের বই ছাপা নিয়ে প্রতি বছর দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক নানা জটিলতা সৃষ্টি করে।এবার শতভাগ নিজস্ব টাকায় বই ছাপাবে সরকার। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঠিকাদারদের অর্থ ছাড় না করলে এ লক্ষ্য ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যানের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা। কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর নির্বাচনী বছর হওয়ায় সরকারের সফল এ ইস্যুকে কাজে লাগাতে চায়। বর্তমান সরকার আগামী নির্বাচনে এ ইস্যুকে অন্যতম সফল এজেন্ডা হিসেবে প্রচার করতে চায়। এজন্য অক্টোবরের মধ্যে বই ছাপার সব কাজ শেষ করতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
এনসিটিবি’র কর্মকর্তারা জানান, সরকারের নির্দেশে কৃষির কাঁচামালের সব টেন্ডার ইতিমধ্যে দেয়া হয়েছে। আর বইয়ের মান আরো ভালো করতে মাঠপর্যায়ে বই ইন্সফেকশন করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রদবদল হচ্ছে। মাধ্যমিক স্তরের ইন্সফেকশন টিম বালটিক বিডিকে চলতি বছর কাজ না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখানে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ দেয়া হবে। বালটিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নিম্নমানের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান থেকে উৎকোচ নেয়াসহ নিয়মিত মনিটরিং না করার অভিযোগ রয়েছে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যানের চলতি দায়িত্বে থাকা সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) ড. মিয়া ইনামুল হক সিদ্দিকী বলেন, এবার নির্বাচনী বছর হওয়ায় আগে থেকেই বই ছাপার কাজটি শেষ করতে চাই। আগামী ৩০শে অক্টোবরের মধ্যেই বই ছাপিয়ে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এটিপিপি অনুমোদন করিয়েছি। এরই মধ্যে শিক্ষক সহায়িকা ছাপানোর টেন্ডার আহ্বান করেছি। চলতি মাসের মধ্যে পাঠ্যবই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে। আগামী মাসে দরপত্র মূল্যায়ন শেষ করা হবে। আগামী ২৫শে ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যান দেশে ফেরার পর প্রথম বৈঠকে বেশ কয়েকটি এজেন্ডা রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ইন্সফেকশন টিম বালটিক বিডির ব্যাপারে নানা অভিযোগের বিষয়টি আছে। বইয়ের মান ঠিক রাখতে এবার কাউকে এককভাবে কাজ দেয়া হবে না বলে জানান তারা। জানা গেছে, চলতি বছর প্রাথমিকের বই মনিটরিং করেন কন্টিনেন্টাল বিডি। তারা মাত্র ৫৪ লাখ টাকায় এ কাজ করেন। এর আগের বছর ব্লু ব্লাইট নামে অন্য অরেকটি প্রতিষ্ঠান এ কাজ করেন ৩ কোটি টাকায়। সরকারের প্রায় আড়াই কোটি টাকা সাশ্রয় হওয়ায় এনসিটিবি ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কন্টিনেন্টাল ও এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট। প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছর খুব ভালো কাজ করেছে বলে স্বীকার করে ডিপিই মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, এবার বইয়ের মান ভালো হওয়ার পিছনে এ প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তারা দিনরাত মাঠে থেকে মনিটরিং করেছে।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার এটিপিপি গত ২৩শে জানুয়ারি অনুমোদন দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর গত রোববার প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার এটিপিপি অনুমোদন দিয়েছে প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকের বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে আগামী মাসের ৫ই মার্চ। টেন্ডারে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বই ছাপার কাজ পাওয়া ঠিকাদারদের সঙ্গে ৬ই জুন চুক্তি করা হবে। সরকারি পৃষ্ঠা ২ কলাম ৫
ক্রয়নীতি অনুযায়ী (পিপিআর) ঠিকাদারদের ৪৯ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ৯ আগস্টের মধ্যে অর্ধেক বই সরবরাহ করতে হবে। ৮৪ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৪ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই ঠিকাদারদের সরবরাহ করতে হবে। মাধ্যমিক স্তরের (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) কাগজ ও আর্টকার্র্ডসহ বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে ২৮শে ফেব্রুয়ারি। কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি হবে ১লা জুলাই। আর ২৯শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই সরবরাহ করতে হবে। ঠিকাদারদের কাগজসহ মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার (এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ও আলিম ভোকেশনাল) টেন্ডার আহ্বান করা হবে ২৭শে মার্চ। কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করা হবে ১১ই জুলাই। আর ১৭ই অক্টোবরের মধ্যে বই সরবরাহ করতে হবে। কাগজ ছাড়া (এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ও আলিম ভোকেশনাল) বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে ২রা মার্চ। কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করা হবে ১৫ই জুন। ২১শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বই সরবরাহ করতে হবে। ব্রেইল ও প্রাক-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে ২০শে এপ্রিল। কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করা হবে ৮ই আগস্ট। বই সরবরাহ করতে হবে ২৮শে নভেম্বর। এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, মাধ্যমিকস্তরের বইয়ের চাহিদার চেয়ে মাউশিকে চিঠি দেয়া হয়েছ। ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে চাহিদা পাঠাতে বলা হয়েছে। অন্ধদের ব্রেইল বইয়ের চাহিদা জানাতে সমাজ সেবা অধিদপ্তরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। গত বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ চাহিদা বেশি নির্ধারণ করে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক মো. আবদুল মজিদ বলেন, এবার ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় বই দেয়া হবে। প্রাথমিকস্তরের বইয়ের চাহিদা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে চাওয়া হয়েছে। আশা করছি দুই একদিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে।
সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান তোফায়েল খান বলেন, দুই মাস কেন আরো আগে চাইলে আরো আগেও কাজ করতে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু এনসিটিবি আমাদের সেই সহযোগিতা করতে হবে। বর্তমান চেয়ারম্যান কাউকে ক্ষমতা না দিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন। তার এ খামখেয়ালির কারণে ব্যবসায়ীরা দুই মাসের অতিরিক্ত ব্যাংক সুদ দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া চলতি বছর খুব ভালোভাবে বইয়ের কাজ শেষ করেছি। কিন্তু তারপরও আন্তর্জাতিক টেন্ডার দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এসব কারণে বর্তমান চেয়ারম্যানের ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারছি না।
চেয়ারম্যানের ফেরার প্রথম বৈঠকে ইন্সফেকশন টিম বালটিকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের ফায়সালা করা হবে। এই প্রতিষ্ঠানটি দায়সারা মনোভাবের কারণে গেল বছরের পিএ প্রিন্টার্সসহ বেশ কয়েকটি প্রিন্টার্স যথাসময়ে বই দিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তাদের কাজ অন্যকে দিয়ে করাতে বাধ্য হয় এনসিটিবি। তারা ১২ বছর ধরে মাধ্যমিক স্তরের বই ইন্সফেকশন করছে।
মুদ্রণ সমিতির নেতারা বলছেন, বর্তমান চেয়ারম্যান কাউকে দায়িত্ব না দিয়েই প্রায় এক মাস ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তার অনুপস্থিতিতে আমরা কোনো বিল পাচ্ছি না। জানুয়ারির মধ্যে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু এখনও টাকা পাচ্ছি না। এসব কারণে বর্তমান চেয়ারম্যানের ওপর আস্থা রাখতে পারছি না। এ ছাড়া চলতি বছর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক থেকে টাকা না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে প্রাথমিকের বই ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যান বিদেশ যাওয়ার আগে আন্তর্জাতিক টেন্ডার ও বিশ্ব ব্যাংক থেকে অর্থ নেয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করে গেছেন। এটা নিয়ে মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। অন্যদিকে বর্তমান চেয়ারম্যানের প্রশ্রয়ে শিক্ষামন্ত্রীর পিএস নাজমুল হকের ভগ্নিপতি অ্যাকাউন্ট শাখার মনিরুল ইসলাম ও তার বউ এনসিটিবির বিকল্প সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তারা অহেতুক কর্মকর্তাদের হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন করেন। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে এনসিটিবিতে ৫ জনকে জুতাপেটা করে পিএসের বোন ড. তৌফিকা আক্তার ওএসডি হয়েছেন।