নানা উদ্যোগের পর অবশেষে পাটখড়ির ছাই বা ‘জুট স্টিক চারকোল’ রপ্তানির জট খুলেছে। এখন প্রতি মাসেই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পাটখড়ির ছাই রপ্তানি হচ্ছে। ফলে বিদেশ থেকে আসছে মূল্যবান রপ্তানি আয়। জট কেটে যাওয়ার পর এ খাতে নতুন বিনিয়োগে কারখানা গড়ে তুলছেন উদ্যোক্তারা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিমাসে গড়ে ৬০ হাজার ডলার মূল্যের পাটখড়ির ছাই রপ্তানি হয়। তবে জট খোলার পর নভেম্বর থেকে পাল্টে যায় এই চিত্র। ওই মাসে সাড়ে পাঁচ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় হয় ৬ লাখ ১৬ হাজার ডলার, যা জানুয়ারিতে দাঁড়ায় সাড়ে পাঁচ লাখ ডলার।
চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এই উদীয়মান খাতে রপ্তানি আয় হয় ১৯ লাখ ৫৫ হাজার ডলার, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২০ লাখ ৮৪ হাজার ডলার। রপ্তানি আয় কিছুটা কমলেও জট খোলায় আশার আলো দেখছেন রপ্তানিকারকেরা।
প্রস্তাবিত বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির আহ্বায়ক মির্জা জিল্লুর রহমান গত বৃহস্পতিবার স্বদেশ নিজ ২৪ ডটকমকে বলেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে জাহাজ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পর দুই মাস আগে পাটখড়ির ছাই রপ্তানিতে জটিলতা কেটেছে। খুব শিগগির এই খাতে রপ্তানি আয় বাড়বে।
জাহাজ কোম্পানির কর্মকর্তা ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের শুরুতে কনটেইনারে পাটখড়ির ছাই পরিবহনের সময় বেসরকারি ডিপো ও বিদেশের বন্দরে এসব কনটেইনারে চারটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পাটকাঠি পুড়িয়ে তৈরি হওয়া ছাই ঠান্ডা হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে কনটেইনারে বোঝাই করায় এসব দুর্ঘটনা ঘটে। এরপরই বড় দুর্ঘটনার শঙ্কায় অধিকাংশ জাহাজ কোম্পানি পাটখড়ির ছাই পরিবহনে আগ্রহ হারায়। এতে পণ্যটির রপ্তানি হোঁচট খায়।
এ অবস্থায় গত বছরের ২৮ মে এ খাতের রপ্তানিকারকেরা বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মির্জা আজমের কাছে চিঠি দিয়ে জটিলতা নিরসনের আহ্বান জানায়। এর পরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যস্থতায় জাহাজ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয় রপ্তানিকারকদের। এসব বৈঠকের পর নানা শর্ত সাপেক্ষে এই রপ্তানি পণ্য পরিবহনে সম্মত হয় বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলো। তারা ঝুঁকি কমাতে চারটি সনদ নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয়।
এর একটি হলো ‘সেলফ হিটিং’ সনদ, যা দেওয়া হয় পণ্যটি নির্ধারিত তাপমাত্রায় নিজে নিজে জ্বলে কি না, তা পরীক্ষা করে। এরপরেই রয়েছে চারকোলে থাকা কার্বনসহ নানা উপাদানের তথ্যসম্পর্কিত সনদ। এ ছাড়া পাটখড়ির ছাই উপাদনের পর কত দিন ধরে ঠান্ডা করা হয়েছে তার সনদ। উৎপাদনের পর অন্তত ১৬ দিন ধরে ঠান্ডা করতে হয় ছাই। কনটেইনারে বোঝাই করার সময় পণ্য পরীক্ষা করে ‘ভেরিং’ সনদ নিতে হয়। আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে এই চারটি সনদ জমা দেওয়ার পরই পাটখড়ির ছাইবাহী কনটেইনার জাহাজে তুলতে সম্মত হয় জাহাজ পরিচালনাকারীরা।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী স্বদেশ নিজ ২৪ ডটকমকে বলেন, কোনো জাহাজে কনটেইনার পরিবহনের সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে প্রাণহানি এবং হাজার কোটি টাকার পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে। এই ঝুঁকির কারণেই পাটখড়ির ছাইবাহী কনটেইনার পরিবহনে ঝুঁকি নেয়নি বিদেশি বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। এখন বিদেশি জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো নির্দেশনা প্রণয়ন করায় এই পণ্য পরিবহনে আর শঙ্কা নেই।
রপ্তানিকারকেরা জানান, ফরিদপুর, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, পাবনাসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা চারকোল কারখানার বিশেষ চুল্লিতে পাটকাঠি পুড়িয়ে ছাই করা হয়। তিন থেকে চার দিন পোড়ানোর পর চুল্লির ঢাকনা খুলে ছাই সংগ্রহ করে ঠান্ডা করতে হয়। এসব ছাইয়ের মধ্যে গড়ে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কার্বন উপাদান থাকে। টনপ্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০ ডলারে রপ্তানি হচ্ছে এই পণ্য। পাটখড়ির ছাইয়ে থাকা কার্বন পাউডার দিয়ে প্রসাধনসামগ্রী, ব্যাটারি, কার্বন পেপার, পানির ফিল্টারের উপাদান, দাঁত পরিষ্কার করার ওষুধ ও ফটোকপি মেশিনের কালি তৈরি করা হয়। পাটখড়ির ছাইয়ের ৯৮ শতাংশ যায় চীনে। চীনে এই পণ্যের চাহিদার কারণে সেখানকার উদ্যোক্তারাও বাংলাদেশে কারখানা গড়ে তুলেছেন।
বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির হিসাবে, এই খাতে এখন ৩০টি কারখানা রয়েছে। তবে কাস্টমসের তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে ২৭টি কারখানা পাটকাঠির ছাই রপ্তানি করছে। অন্যরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে রপ্তানি করছে। এই খাতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। রপ্তানি জট খোলার পর এখন নতুন বিনিয়োগও হচ্ছে। ১২ মার্চ রাজবাড়ীতে নতুন একটি কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।
ফরিদপুরে গত বছর যাত্রা শুরু করা চায়না বাংলা এগ্রো প্রোডাক্টসের প্রতিষ্ঠাতা সালাউদ্দিন মিয়া স্বদেশ নিজ ২৪ ডটকমকে জানান, রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিনিয়োগ নিয়ে ঝুঁকিতে পড়েছিলেন। রপ্তানি শুরু হওয়ার পর এখন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।
দেশ থেকে ২০০৯-১০ সালে এই পণ্য রপ্তানি শুরু হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে রপ্তানি দাঁড়ায় ৪৭ হাজার ৭৫২ ডলারে। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ লাখ ৮২ হাজার ডলারে।