সিলেটে কেন খুন হলেন ছাত্রদল নেতা রাজু?

সিলেটে ছাত্রদল নেতা রাজু হত্যাকাণ্ড নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে আরিফুল হক চৌধুরীর বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। আরিফুল নিজেও বলেছেন, আমার বিজয় যারা সহ্য করতে পারেনি তারাই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। শনিবার রাতে নবনির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বিজয় মিছিল পরবর্তী সময়ে ফয়জুল হক রাজুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রাজু সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সাবেক কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক। এদিকে রাজু খুনের ঘটনায় ক্ষোভ বিরাজ করছে সিলেটে।গতকাল দুপুরে নিহত রাজুর লাশ নিয়ে বিক্ষোভ করেছে তার সহকর্মী ও ছাত্রদল নেতারা। রাজুর লাশের ময়নাতদন্ত চলাকালে হাসপাতাল এলাকায় গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আরিফুল হক চৌধুরী। শনিবার রাতে নিজ কার্যালয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের ফলাফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। ফলাফল ঘোষণার পর মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে নিয়ে হাজারো নেতাকর্মী মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা ও মিছিল নিয়ে কুমারপাড়াস্থ বাসভবনে আসেন। ওই মিছিল বহরে মোটরসাইকেল নিয়ে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রদল নেতা ফয়জুল হক রাজু ও তার বন্ধু জাকির হোসেন উজ্জ্বল এবং লিটন। তারা মিছিল নিয়ে আরিফুল হক চৌধুরীর বাসার প্রধান ফটক পর্যন্ত যান। এ সময় সেখানে শত শত নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। তবে মিছিলকে কেন্দ্র করে মোটরসাইকেল মহড়ার সময় ছাত্রদলের রকিব গ্রুপের কর্মীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় রাজু ও তার সহকর্মীদের। রকিবের অনুসারীরা হচ্ছেন ছাত্রদলের নতুন কমিটির নেতারা। আর রাজু ছিলেন পদবঞ্চিত ছাত্রদল নেতা। নগরীর উপশহর গ্রুপ ছাত্রদলের নেতা হচ্ছে রাজু। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সিলেট ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর থেকে সিলেটে বহু ভাগে বিভক্ত ছাত্রদলের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিজয় মিছিলের পরপর মেয়র আরিফের বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন রাজু সহ তার অপর দুই সহকর্মী। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে বাসার গলির মুখে পৌঁছামাত্র কয়েকজন সশস্ত্র ব্যক্তি তাদের উদ্দেশ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে। এতে রাজু পায়ে গুলিবিদ্ধ হলে তারা মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়েন। এ সময় রাজু ও তার সহকর্মীদের এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। তাদের কোপানোর দৃশ্য দেখে আশেপাশের ব্যবসায়ীরা ভয়ে দোকানপাট বন্ধ করে দেন। কয়েক মিনিট কোপানোর পর রাজু সহ তিনজন নিস্তেজ হয়ে পড়লে হামলাকারীরা চলে যায়। এদিকে ঘটনার পর গুরুতর আহত অবস্থায় রাজু ও তার দুই সহকর্মীকে উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাতে রাজুর মাথায় জরুরি অস্ত্রোপচার করলেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। রাত ১১টার দিকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররা রাজুকে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত উজ্জ্বল ও লিটন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদিকে রাজু খুনের ঘটনায় রাতেই ছাত্রদলের উপশহর গ্রুপের কর্মীরা বিক্ষোভ করে। হাসপাতাল এলাকায় তাদের দফায় দফায় বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। পুলিশ জানায়, নিহত ছাত্রদল নেতা রাজুর শরীরে প্রায় ৪০টিরও বেশি আঘাত রয়েছে। মাথার ডানদিকে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল গুরুতর। তার একটি কান শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়। পায়ে রয়েছে গুলির আঘাত। অন্য দুজনকে কোপানো হয়েছে। এর মধ্যে উজ্জ্বলের অবস্থা এখনো শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন ওসমানী হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এদিকে গতকাল সকাল থেকেই হাসপাতালে ছুটে যান নিহত রাজুর সহকর্মী ছাত্রদল কর্মীরা। তারা গিয়ে মর্গের সামনে বসে থাকেন। বেলা একটার দিকে হাসপাতাল এলাকায় যান নবনির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। প্রথমে তিনি হাসপাতালের চতুর্থ তলায় ভর্তি থাকা আহত দুজনকে দেখেন এবং তাদের শারীরিক অবস্থার খবর নেন। পরে কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন সহ নেতাকর্মীদের নিয়ে মর্গের সামনে যান। সেখানে আরিফুল হক চৌধুরীকে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত রাজুর স্বজনরা। এ সময় ছাত্রদলের উপশহর গ্রুপের কর্মীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন- ‘আমরা আপনার বিজয় মিছিলে গিয়েছি। লাশ হতে যাইনি।’ আরিফুল হক চৌধুরীও এ সময় কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘রাজু আমাকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে মিছিল সহকারে বাসা পর্যন্ত এসেছে। যারা আমার বিজয়কে সহ্য করতে পারেনি তারাই ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে রাজুকে হত্যা করেছে।’ মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী অবিলম্বে রাজুর খুনিদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এদিকে বেলা দুইটার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে নিহত রাজুর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ সময় রাজুর সহকর্মীরা তার লাশ নিয়ে মেডিকেল এলাকায় মিছিল বের করেন। প্রধান ফটক পর্যন্ত মিছিল করার পর রাজুর লাশ তারা মরদেহবাহী গাড়িতে তুলে দেন। বিকালে নগরীর উপশহর এলাকায় রাজুর লাশের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লাশ পাঠিয়ে দেয়া হয় মৌলভীবাজারের রাজনগর গ্রামের বাড়িতে। এদিকে সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি মোশারফ হোসেন জানিয়েছেন, রাজু নিহত হওয়ার ঘটনায় বিকাল পর্যন্ত পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ থানায় এজাহার নিয়ে আসেনি। তবে রাজুর অভিভাবকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা দাফনের পর থানায় এসে এজাহার দাখিল করবেন বলে জানান। নিহত রাজুর পিতা ফজর আলী বাস করেন নগরীর উপশহর এলাকায়। তাদের মূল বাড়ি মৌলভীবাজারের রাজনগরে। রাজু সিলেট ল’ কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মাশরুর রাসেল সাংবাদিকদের জানান, নতুন কমিটিতে স্থান পাওয়া না পাওয়া নিয়ে এ সংঘাত। কমিটিতে স্থান পাওয়া রকিবের নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয়েছে। রাজু একজন দক্ষ সংগঠক ছিল বলে দাবি করেন রাসেল। রাজুর ফুফা মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আলী হোসেন বাচ্চু জানান, ৩ ভাই ও এক বোনের মধ্যে রাজু ছিল সবার বড়। তার বোন থাকেন সপরিবারে জার্মানিতে। ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন বর্তমানে ইউরোপের একটি দেশে অবস্থান করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *