নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধ ভারত কি নিজস্ব রোহিঙ্গা তৈরি করছে?

আসামে ৩০শে জুলাই প্রকাশিত নতুন ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন্সে (এনআরসি) রাজ্যটির ৪০ লাখ অধিবাসীকে বাদ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের থেকে ভারতের জাতীয়তা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের শনাক্ত করার জন্য খসড়া এনআরসি তৈরির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। তবে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজ্যটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে এমন আশঙ্কা প্রত্যাখ্যান করেছে তারা।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে আসাম সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য। সেখানে বসবাসকারী ৩ কোটিরও বেশি অধিবাসী নিজেদের বৈধ নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য সাড়ে ৬ কোটি নথি কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেন। জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গত পাঁচ বছর ধরে এগুলো যাচাই করে কর্তৃপক্ষ।এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ১৭৮ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এনআরসি কর্তৃপক্ষ আসামের ২৮ লাখ মানুষের নাগরিকত্বের আবেদন গ্রহণ করে। বাকি ৪০ লাখ আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন তারা।

নাগরিকত্ব নির্ধারণে এ ধরনের যাচাই প্রক্রিয়ার পটভূমি রচিত হয় ১৯৪৭ সালে, যখন বৃটিশরা ভারতবর্ষকে দুটি পৃথক রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত করে। ১৯৫১ সালেও আসামে নাগরিকদের তালিকা করা হয়। কিন্তু তা কখনোই কার্যকর হয়নি। দেশভাগের ২৪ বছর পর বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে নৃশংস যুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ গঠিত হয়, তার কারণে লাখ লাখ শরণার্থী ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে আশ্রয় নেয়।

আসামে বসবাসকারী অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ইস্যুটি দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। ২০০৮ সালে আসাম ভিত্তিক একটি এনজিও সুপ্রিম কোর্টে এই মর্মে অভিযোগ করে যে, রাজ্যটিতে ৪১ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে ভোটার হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যটির ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স (এনআরসি) হালনাগাদ করার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন। হালনাগাদকৃত তালিকায় যেসব অধিবাসী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পূর্ব থেকে আসামে বসবাস করে আসছে, তাদের ও তাদের বংশধরদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সে অনুযায়ী, এনআরসি কর্তৃপক্ষ আসামের অধিবাসীদের নাগরিকত্বের সপক্ষে প্রমাণ হাজির করতে বলে। যারা ১৯৭১ সালের পরে জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের পূর্বপুরুষের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের প্রমাণ হাজির করতে বলা হয়। এই প্রক্রিয়ার অধীনে সবাইকেই এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগসূত্র থাকার প্রমাণ হাজির করতে বলা হয়, ১৯৫১ সালের নাগরিক তালিকা বা ১৯৬৫-৬৬ ও ১৯৭০-৭১ সালে প্রস্তুতকৃত ভোটার তালিকায় যার নাম আছে।

এই এনআরসি প্রক্রিয়া ভারতের মোট নাগরিকের একটি বিরাট অংশকে রাষ্ট্রহীন করেছে। ভারতের সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় এনআরসি’র নানা অসঙ্গতি তুলে ধরা হচ্ছে। ছয় বছরের এক শিশুকে নতুন নাগরিকের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ একই সঙ্গে জন্ম নেয়া তার জমজ সহোদরের নাম তালিকায় রয়েছে। ৭২ বছরের এক বৃদ্ধাকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আবার পিতা ও বোনের নাম নাগরিক তালিকায় নথিভুক্ত হলেও ১৩ বছর বয়সী এক বালকের নাম বাদ দেয়া হয়েছে।

নতুন এনআরসি তৈরির নির্দেশ দেয়া সুপ্রিম কোর্ট এখন তালিকা থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি এনআরসি নিয়ে মানুষের বিভিন্ন অভিযোগ ও দাবি যাচাই করার জন্য নতুন প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, সুপ্রিমকোর্টের আপিল প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশ করা হবে। ওই প্রক্রিয়া শেষে কী ঘটবে তা পরিষ্কার না। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর প্রভাব হবে অনেক ভয়ঙ্কর ও দীর্ঘস্থায়ী।
এনআরসি এমন একটি পরিস্থিতির তৈরি করতে পারে যার সঙ্গে মিয়ানমারের ঘটনাবলীর সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গারা যে অধিকার ভোগ করছিল, ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইনে লাখ লাখ রোহিঙ্গার কাছ থেকে সে অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। আসামের এনআরসিতে ক্ষতিগ্রস্ত বিপুলসংখ্যক মানুষের মতো রোহিঙ্গারাও বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান, অধিকার হরণ ও অব্যাহত শত্রুতার কারণে মিয়ানমার গত কয়েক বছরে চূড়ান্তভাবে নিষ্ঠুর সহিংসতা ও জাতি নির্মূল অভিযানের দিকে ধাবিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠরা যে অভিযোগ তুলেছিল, আসামে সেগুলোরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

আসামের মুসলিমরা যখন ক্ষমতায় বসার অন্যতম উপায় হিসেবে ব্যবহার হতে শুরু করে, তখন থেকেই জাতিগত দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বিদেশিদের রাজ্য থেকে বের করে দেয়া ও তাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তোলে আসামের ছাত্র-রাজনীতিবিদরা। পরে তারা ১৯৮৫ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ও আসামে সরকার গঠন করে। এ দশকে বাঙালি-মুসলিম ও হিন্দুরা টার্গেটে পরিণত হয়।
পরে হিন্দু জাতীয়দাবাদের উত্থান হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। এরা বাঙালি অভিবাসীদের দুই ভাগে ভাগ করে। বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম। বাঙালি হিন্দুদের তারা মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত শরণার্থী হিসেবে উল্লেখ করে। আর বাঙালি হিন্দুদের বিপজ্জনক বিদেশী হিসেবে মনে করে, যারা অবৈধভাবে ভারতের ভূ-খণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে।

বাঙালিদের বিরুদ্ধে আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠদের মত ও পুরো ভারতজুড়ে মুসলিম-বিদ্বেষী মনোভাব, এনআরসিতে উভয়ই বিবেচনা করা হয়েছে। এনআরসি প্রকাশের রাজনৈতিক সুবিধা লুফে নিতে দেরি করেনি ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এই দলটি ভারতকে হিন্দুদের ‘প্রাকৃতিক আবাসস্থল’ হিসেবে মনে করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুসলিমদের হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, এমন দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তার ঘনিষ্ঠ সহচর বিজেপি প্রধান অমিত শাহের ইতিহাসও অভিন্ন। এনআরসি নিয়ে অমিত শাহ জোর দিয়ে বলেছেন, তার দল এনআরসি বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। কেননা এটা জাতীয়, সীমান্ত ও দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়। ভারত যদি রাষ্ট্রহীন ঘোষিত ৪০ লাখ মানুষকে সে দেশে বসবাসের অনুমতি না দেয়, তাহলে তাদের কোথাও রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সরকার নতুন বন্দী শিবির নির্মাণ ও পুরনো বন্দীশিবিরগুলোর ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে। ভারত সরকার ইতিমধ্যেই সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেছে যে, এনআরসি প্রক্রিয়ার ফলে কাউকে ভারত থেকে বের করে দেয়া হবে না।

সর্বোপরি, আসামে রাষ্ট্রহীন ঘোষিত বেশিরভাগ মানুষই মুসলিম। তাদের ওপর ভোট প্রদানে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতে পারে। বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারে- এমন বিপুলসংখ্যক মানুষকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার পাশাপাশি বিজেপি আসামের হিন্দু ভোটারদের সমর্থন পেতে এনআরসিকে কার্যকর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতেই ২০১৯ সালে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ।
(নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ। নিবন্ধটি লিখেছেন হার্তশ সিং বাল। তিনি ভারতের রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ম্যাগাজিন দ্য ক্যারাবান-এর রাজনৈতিক সম্পাদক।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *