বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ, রাজনৈতিক দর্শন অপরিহার্য বলে মনে করেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি বলেছেন, ‘ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হলেও সেটি সম্ভব হয়নি এবং কখনো মুছে ফেলা যাবে না। মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর যে স্থান সেটি শূন্য হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তরুণ প্রজন্ম ও সাধারণ মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।’ একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রফেসর আনিসুজ্জামান এসব কথা বলেন।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর অপরিহার্য প্রাসঙ্গিতার বিষয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, পাকিস্তানের ২৪ বছর শাসনামলে বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কারাবরণ করেছেন এবং চরম মূল্য দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তার অনুপ্রেরণাতেই বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। তিনি উপস্থিত না থাকলেও তার নামেই মুক্তিযুদ্ধ পারিচালিত হয়েছে।তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিয়েছিলেন। যে আদর্শগুলোকে তিনি সামনে তুলে ধরেছিলেন তা আমাদের সংবিধানের চার মূলনীতি বলে জায়গা পেয়েছিল। পরবর্তীকালে যারা এই চার মূলনীতিতে আঘাত করেছিলেন তারা বাংলাদেশের মূল আদর্শ থেকে কম বেশি বিচ্যুত হয়েছিলেন। দেশকে তারা পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড না হলে এটি সম্ভবপর হতো না। কেন না তিনি চার মূলনীতিকে নিজের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান বিবেচনা করতেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ যাতে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করে সেইজন্য বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আজকে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে সংবিধানের চার মূলনীতি পুনঃস্থাপিত হয়েছে সত্য, কিন্তু সেই সঙ্গে রাষ্ট্র ধর্মও রয়ে গেছে যেটা কি না ধর্ম নিরপেক্ষতার সঙ্গে যায় না। তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রভূত উন্নয়ন সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এখনো আমাদের দেশ সাম্প্রদায়িকতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। আজকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অধিকার স্বীকার করে নেয়ার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে দ্বিধা রয়েছে। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে এসব প্রশ্নের সুরাহা হতো। আজকের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু সেই কারণেই অপরিহার্য। তাকে কেন্দ্র করেই আমরা স্বাধীনতার মূলমন্ত্র খুঁজে পাই এবং সেটাকে আবেগ, বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে ধরে থাকি।
ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম কখনোই মুছে ফেলা যাবে না- এমন উল্লেখ করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আমরা দেখি যে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে রণ ধ্বনি ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে পাকিস্তানি আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ধ্বনি স্থাপিত হলো। বেতার হলো রেডিও। এমনকি পাকিস্তানি ভাবাদর্শের ভিত্তিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য যে, দেশের অধিকাংশ মানুষই এই ভাবধারা প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি বলেন, এখন বঙ্গবন্ধুর কথা যেভাবে বলতে পারছি একটা সময় এটা বলা সম্ভব ছিল না। তারপরও মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর যে আসন সেটি শূন্য হয়নি।
আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার যে চেষ্টা হয়েছিল, সেটি ব্যর্থ হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও বঙ্গবন্ধুর নাম সবার কাছে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
তরুণ প্রজন্মের ওপর বঙ্গবন্ধুর প্রভাব সম্পর্কে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছিলেন তার তুলনা খুব কম দেশের ইতিহাসে পাওয়া যায়। মাঝখানে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নাম যে পিছনে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে, সেই অপচেষ্টা থেকে আমরা এখন মুক্ত। আমরা এখন স্বাভাবিকভাবে, সত্যভাবে বঙ্গবন্ধুকে জানছি এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে তাকে তুলে ধরছি। এই সুযোগটি না হলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু জানতো না এবং আমাদের দেশের ইতিহাস তাদের কাছে পুরোপুরি অজ্ঞাত হয়ে থাকতো। তিনি বলেন, এখন তো সবাই জানছে যে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ২৪ বছরে বঙ্গবন্ধুর ভ্থমিকা কি? তিনি কেমন নির্লোভ মানুষ ছিলেন। ক্ষমতার জন্য লালায়িত না হয়ে তিনি কিভাবে দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে তরুণ প্রজন্ম ও সাধারণ মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এখন নানা ভাবেই তাকে জানার চেষ্টা হচ্ছে এবং সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হতে বাধ্য।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, আমার মনে হয় যে, ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্নে বর্তমান আওয়ামী লীগ কিছুটা দুর্বল। কেন না তারা লোকের মুখের দিকে চেয়ে হোক কিংবা ভোটের কথা চিন্তা করে হোক, রাষ্ট্রধর্মকে সংবিধান থেকে বাদ দিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে তিনি যখন অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলতেন তখন সদ্য পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে। সেই অবস্থায়ও তিনি বলতে পেরেছিলেন যে, আমরা ধর্ম নিরপেক্ষ হবো। এসব কথা তখন যদি বঙ্গবন্ধু বলতে পারেন তাহলে আমাদের নেতারা এখন কেন বলতে পারেন না। এই একটি কাজ করলে আমরা ৭২ এর সংবিধানে সম্পূর্ণরূপে ফিরে যেতে পারতাম। মাঝে মাঝে শুনতে পাই ধর্মভিত্তিক সংগঠনের প্রস্তাব অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন আনা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এটি হতো বলে মনে হয় না। তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ আমরা চার মূলনীতির মধ্যে খুঁজে পাব। তিনি কখনো দাবি করেননি যে, তিনি একজন রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। একজন মাঠপর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। সেটি তিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। তার বক্তৃতা বিবৃতিতে আমরা যেটি পাই, সেখানে আমরা দেখি যে, ক্রমেই তিনি সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছেন। আমাদের সমাজ যাতে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ হয়ে উঠে, সেই চেষ্টা তিনি করেছেন। প্রথমে বাঙালির অধিকার তারপরে হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন। আনিসুজ্জামান বলেন, মোটের ওপর এই সরকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী- এটি অস্বীকার করা যাবে না।
আমার মনে হয় প্রকাশ্যে তাদের (আওয়ামী লীগ) কিছু দ্বিধা আছে। কিন্তু অন্তরে তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে। আর দ্বিধাটা হলো, যেহেতু একবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রচলিত হয়ে গেছে, তারা ভাবছেন যে এটি পরিবর্তন করতে গেলে হয়তো মানুষের মনে অসন্তোষ দেখা দেবে। এই ঝুঁকিটা তারা নিতে চাইছেন না। তবে, আমি মনে করি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অধিকাংশ বিষয় ধারণ করে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতি স্মরণ করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখা হয় ১৯৭৪ সালের মে মাসে গণভবনে। তার মনের অনেক কথাই তিনি বলেছিলেন। দেশের সমস্যা নিয়ে তিনি চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। প্রশাসনকে তিনি আরো শক্ত করে গড়ে তুলতে চান, সে কথাও বলেছিলেন। এটিই তার সঙ্গে আমার শেষ স্মৃতি।
এরপরেই আমি বিদেশে চলে যাই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দুই তিন দিন আগে ফিরে আসি। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শোনার মুহূর্তটা আমার জন্য ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যে মূল্যবোধের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে সেই মূল্যবোধ একেবারে বিসর্জিত হলো। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ বন্ধ রাখার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল- এটি ছিল খুবই বেদনাদায়ক। তার খুনিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল যা ছিল দুর্ভাগ্যজনক। তবে, আশার কথা যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ শেষ হয়েছে।