রাজধানীতে কোনো বস্তি থাকবে না। এর স্থলে ২০তলা করে ভবন গড়ে তোলা হবে। এখন যেমন বস্তিবাসী ভাড়া দিয়ে থাকেন তেমনি তখন তারা ওসব ভবনেও দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দিয়ে বসবাস করবেন। গতকাল প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, রাজধানীর বস্তিগুলো বহুতল ভবনে প্রতিস্থাপিত হবে, যাতে করে নগরবাসী উন্নত স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে জীবন-যাপন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিদিন নানা প্রয়োজনে দরিদ্র মানুষকে রাজধানীতে আসতে হয়।আবার আমাদের দৈনন্দিন কাজেও এই শ্রমিক শ্রেণির প্রয়োজন পড়ে। তারা যেন একটু শান্তিতে বসবাস করতে পারে সেজন্যই তাদের বসবাসের জন্য একটু ভালো পরিবেশের দরকার।
বস্তিবাসীরা এখন বস্তিতে যে ভাড়া দিচ্ছেন সে ভাড়াতেই এখানে থাকবেন, অবশ্য তাদের ভাড়া দিয়েই থাকতে হবে। দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন হচ্ছে কাজেই তারও যেন সেই ছোঁয়াটা পায় সেটা আমাদের দেখতে হবে। তিনি বলেন, কেবল অবস্থাসম্পন্নদের জন্যই নয়, আমাদের উন্নয়ন সকলের জন্য। ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে একই পাইপলাইনে নিয়ে আসতে চীন সরকারের সহযোগিতায় ঢাকা ওয়াসার ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়নাধীন মহাপ্রকল্পের অংশ হিসেবে খিলগাঁও এলাকায় এই দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প নির্মিত হচ্ছে।
রাজধানীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে রাজধানীতে আরো ৪টি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এতে পাগলায় বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় দুটি এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় রায়েরবাজার এবং উত্তরায় আরো দুটি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। অনুষ্ঠানে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একটি ভিডিও উপস্থাপনায় জানানো হয়, ৩ হাজার ৩৭৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প ২০২০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
২৪ হেক্টর জমির ওপর বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনের মাধ্যমে ৫০ লাখ নগরবাসীকে সেবা দেয়া সম্ভব হবে। এলজিআরডি এবং সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান, চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুয়ো এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বক্তৃতা করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ এবং হুইপবৃন্দ এবং সরকারের পদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি ও আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৯৬ পরবর্তী সরকার গঠনের পরই তিনি বস্তিবাসীদের নিজ গ্রামে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ‘ঘরে ফেরা’ কর্মসূচি চালু করেন। বস্তিবাসীদের জন্য তার সরকারের বহুতল ভবন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাই ফ্লাট বাড়িতে থাকবে আর বস্তিবাসীরা থাকবে না, এটা হয় না।
বিদ্যুৎ, পানির প্রিপেইড মিটার থাকবে, তারা যতটুকু ব্যবহার করবে তার বিল দেবে। কারণ, শহর যত উন্নত হয় তার কাজের জন্য এ ধরনের কর্মীও লাগে। কজেই তাদের জীবন-মানটা যেন উন্নত হয় সেদিকেও ভালোভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিছু পরিকল্পনা করেছে যেগুলো তিনি দেখে দিয়েছেন।
কাজও শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, এভাবে সমগ্র ঢাকা এবং ঢাকা ছাড়াও পর্যায়ক্রমে যে পরিকল্পনা করা হবে তাতে জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পরিকল্পনা করেই আমরা কাজ করবো। ভবিষ্যৎ যে উন্নয়ন হবে তার ছোঁয়া এই খেটে খাওয়া নিম্নবিত্তরাও যাতে পায় তা নিশ্চিত করা হবে। কারণ, এই নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের জন্যই আমার রাজনীতি। হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তার সরকারেকে ৬৮টি মামলা মোকাবিলা করতে হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন কাজ করতে গেলেই এভাবে বাধা আসে এবং সেই বাধা অতিক্রম করেই কাজ করতে হয়।
তিনি বলেন, এখন থেকেই যদি আমরা সেই ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পরিকল্পনা নিয়ে নিই তাহলে ভবিষ্যতে আর সমস্যা হবে না। প্রধানমন্ত্রী এ সময় ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর তার সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, ঢাকা ওয়াসার কার্যক্রম আধুনিক ও গতিশীল করার লক্ষ্যে বিলিং সিস্টেমকে ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। ফলে গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ওয়াসার সিস্টেম লসের পরিমাণ শতকরা ৪০ ভাগ থেকে কমে ২০ ভাগে নেমে এসেছে।
অত্যাধুনিক ডিএমএ (ডিস্ট্রিক্ট মিটারড এরিয়া) প্রযুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সিস্টেম লস ৫ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এটির জন্য ঢাকা ওয়াসা সাউথ-ইস্ট এশিয়ার মধ্যে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে প্রশংসা অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় হাতির ঝিলসহ রাজধানীর একটি বড় অংশে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার সমালোচনা করে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টিকারীদের সতর্ক করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকারের পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলেই ঢাকা ওয়াসা পানি উৎপাদন ও সরবরাহে ১০০ ভাগ সক্ষমতা লাভ করেছে।
ঢাকা ওয়াসাকে এখন দক্ষিণ এশিয়ায় পানি সেবাদানকারী সংস্থার ‘রোল মডেল’ হিসেবে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো বিবেচনা করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘ ঘোষিত ‘এসডিজি-২০৩০’ এর ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বরটি হচ্ছে-‘সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ’। পানি সম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা একশ’ বছর মেয়াদি ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ নামে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
এই দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় আগামী একশ’ বছরে পানির প্রাপ্যতা, তার ব্যবহার এবং প্রতিবেশগত বিষয়সমূহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, আগামীতে তিনি সরকার গঠন করতে পারলে রাজধানীর জলাবদ্ধতার মূল কারণ বক্সকালভার্টগুলো উন্মুক্ত করে এর ওপর দিয়ে এলিভেটেড ওয়ে নির্মাণ করে দেবেন। কারণ, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন।
বুড়িগঙ্গার পানি গৃহস্থালির বর্জ্য এবং শিল্পবর্জ্যের মাধ্যমে দূষণ প্রতিরোধে এখানে দু’ধরনের ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমরা একটি কমিটি করে দিয়েছি, এলজিআরডি মন্ত্রীকে দিয়ে, সেখানে দু’ধরনের ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বাস্তবায়নে তাঁরা কাজ করছেন। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা থেকে টঙ্গীর তুরাগ নদী পর্যন্ত এই প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিং করা হবে। কারণ, পানির ধারাটা বজায় রাখতে পারলে বুড়িগঙ্গায় আর দূষণ থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাশাপাশি বালু নদী এবং ধলেশ্বরীও ড্রেজিং করতে হবে। যেন সেখান থেকে পনির প্রবাহটা বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত ঠিক থাকে এবং বৃষ্টির পানিটাও ধরে রাখতে পারে। নদী ড্রেজিং ছাড়া আমাদের এই দেশকে রক্ষার আর কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে সরকার পানি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সুয়ারেজ মাস্টার প্লান প্রণয়ন করেছে।
যার মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে রাজধানী ঢাকা আধুনিক পয়ঃসেবার আওতায় আসবে। তিনি বলেন, আজকে যে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প এটা সেই মাস্টার প্লানেরই একটি অংশ। আমি বিশ্বাস করি-এই ট্রিটমেন্ট প্লান্ট যদি আমরা না করি তাহলে ঐ হাতির ঝিলকে রক্ষা করা সম্ভব নয়, কারণ সেখানকার পানি পচে যায়। তিনি এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা ওয়াসাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এটি বাস্তবায়িত হলে বারিধারা, গুলশান, বনানী, বসুন্ধরা, সংসদ ভবন, ক্যান্টনমেন্ট এলাকাসহ আশপাশের সমগ্র এলাকায় জলাবদ্ধতা ও দূষণ বন্ধ হবে এবং এসব এলাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা আরো সুন্দর হবে।