নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে গ্রেপ্তার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জনসহ ৪২ শিক্ষার্থীর জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত (সিএমএম) ও পৃথক অন্য আদালত তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের কাজে বাধা এবং গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে রাজধানীর বাড্ডা, ভাটারা ও ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন থানায় দায়ের করা মামলায় এসব শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
বাড্ডা থানার মামলায় গ্রেপ্তার ১৪ জন এবং ভাটারা থানার মামলায় গ্রেপ্তার আট শিক্ষার্থী জামিন পান। অন্যদিকে, ধানমন্ডি থানায় পৃথক তিন মামলায় গ্রেপ্তার নয় শিক্ষার্থীকে জামিন দেন আদালত। ধানমন্ডি এলাকায় ভাঙচুর ও পুলিশের কাজে বাধাদানের মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থীর আইনজীবী মহিউদ্দিন ফারুকী মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ঈদ এবং পরীক্ষা এই গ্রাউন্ডে আদালত তাদের জামিন দিয়েছেন।
এছাড়া মামলায় ছাত্রদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছিল না। তারা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাও এজাহারে উল্লেখ করা হয়নি। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের হয়রানি করার জন্যই পুলিশ মামলা করেছে আদালতে- আমরা এমনটি উপস্থাপন করেছি। জামিন পাওয়া ছাত্ররা বেসরকারি ইস্টওয়েস্ট, নর্থসাউথ, সাউথইস্ট ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। জামিনের আবেদন করা শিক্ষার্থীদের বাবা-মা, ভাইবোন ও স্বজনরা গতকাল সকাল থেকে আদালতে ভিড় করতে থাকেন। জামিন পাওয়ার খবর শুনে তারা স্বস্তি প্রকাশ করেন। কারো কারো চোখ বেয়ে পড়ে আনন্দাশ্রু। জামিন পাওয়া শিক্ষার্থীদের স্বজনদের অনেকেই আনন্দে কেঁদে ফেলেন। শিক্ষার্থীদের জামিন দেয়ায় বিচারকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
গতকাল শুনানিতে ২২ শিক্ষার্থীর অন্যতম আইনজীবী মহিউদ্দিন ফারুকী জামিনের জন্য আদালতের কাছে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই ছাত্র। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। মামলার এজাহারেও তাদের নাম নেই। পুলিশ তাদের সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করেছে। শুনানি নিয়ে আদালত জামিন মঞ্জুর করেন।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-কমিশনার মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘রোববার মোট ৪২ জন শিক্ষার্থীর জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত।’ এর আগে ৭ই আগস্ট সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক ২২ শিক্ষার্থীর দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত ২৯শে জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা এলাকায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হন। এরপর ঘাতক বাসচালকের শাস্তি এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন চলাকালে বাড্ডা, বসুন্ধরা ও ধানমন্ডি এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে বিভিন্ন থানায় সংঘাত, ভাঙচুর, উস্কানি ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে এ পর্যন্ত ৫৩টি মামলা দায়ের করে। এসব মামলায় শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। যাদের অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী।
৯ শিক্ষার্থী মুক্ত, স্বজনদের স্বস্তি: নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেমে গ্রেপ্তার হওয়া অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯ জন মুক্তি পেয়েছেন। গতকাল রোববার সন্ধ্যা সোয়া ৭টা নাগাদ তারা কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান। তাদের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে আদালতে জামিন আদেশের কাগজপত্র পৌঁছালেও বিলম্বের কারণে অপর ১৩ শিক্ষার্থীকে আজ সকালে মুক্তি দেয়া হবে বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এর আগে গতকাল দুপুরে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন পান তারা।
কারাফটক থেকে মোবাইলে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর আতঙ্কিত পিতা নাম প্রকাশ না করে মানবজমিনকে বলেন, দুপুরের দিকে বিচারক ২২ শিক্ষার্থীর জামিন দেন। এরপর আমরা কারাগারি আসি। জামিন আদেশ কারাগারে জমা দেয়ার পর আমার সন্তানসহ ৯ জনকে মুক্তি দেয়া হয়। বাকি ১৩ জন শিক্ষার্থীর স্বজনকে তাদের গ্রহণ করার জন্য সোমবার সকাল ৯টা বা ১০টায় কারাফটকে আসতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া। আপনাদের সবার সহযোগিতায় সন্তানকে আমার বুকে ফিরে পেয়েছি। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আপনাদের দোয়া চাই। এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে চাই না।
এর আগে শিক্ষার্থীর স্বজনরা সকাল থেকেই ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জমায়েত হন। তাদের আইনজীবীরা একে একে আদালতে জামিন আবেদন জমা করেন।
সাউথ-ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাহিদুল হকের জামিনের জন্য পিতার সঙ্গে আদালতে যান ছোট বোন জাফরিন হক। জামিন হওয়ার পরই তিনি চিৎকার দিয়ে ‘আব্বু, ভাইয়া জামিন হয়ে গেছে’ বলেই আদালতের বারান্দায় আনন্দে কেঁদে ফেলেন। জাহিদুল নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে গত ৬ই আগস্ট বাড্ডা এলাকায় ভাঙচুরের মামলায় গ্রেপ্তার হন।
ধানমন্ডির এক মামলায় গ্রেপ্তার হন দুই সহোদর মাহমুদুর রহমান ও মাহবুবুর রহমান। মাহমুদ ইউল্যাবে ও মাহবুব বিএফ শাহীন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে এখন আইইএলটিএস করছেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জামিন হওয়ার খবর শুনেই তাদের মা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
বাড্ডার মামলায় গ্রেপ্তার মেহেদী হাসানের জামিনের সংবাদ শুনে তার বাবা এমএ মাসুদ খান আদালতের বারান্দায় কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আজ আমার আনন্দের দিন। ছেলে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে কত যে যন্ত্রণায় ছিলাম, সে কথা কাউকে বোঝাতে পারবো না।’ ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র রেদোয়ান আহমেদের বাবা অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ তার ছেলের জামিনের পর বলেন, খুব ভালো লাগছে। অপর এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র নূর মোহাম্মদের বোন মাবিয়া বললেন, ‘ভাইয়ার জামিন হওয়ায় আমরা একসঙ্গে ঈদ করতে পারবো।