ধর্ষিত সেইসব রোহিঙ্গা নারীদের কথা

৩৩ দিন বয়সী ইয়াসমিন। একটি কম্পলে পেচিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। ছালা দিয়ে তৈরি ছাদের দিকে তাকিয়ে ইতিউতি করছে সে। তার মা মেহের। তাকে তুলে নিলেন। বুকের দুধ পান করানো শুরু করলেন।দেখে মনে হয় তার বয়স ২৫ বছর। তিনি বললেন, এই শিশুটি আমার বাচ্চা। সে পুরোপুরিই আমার। আমার ভালবাসা সে। কিন্তু যখনই তার দিকে তাকাই তখনই স্মরণে আসে এখ নৃশংস ভয়াবহতা।
মেহের রোহিঙ্গা মুসলিম। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যখন রোহিঙ্গা মুসলিম নারীদের গণহারে ধর্ষণ করে তখন তাদের দ্বারা ধর্ষিত হন মেহেরও। আর তাতেই তার গর্ভসঞ্চার হয়ে যায়। এমন নৃশংসতার শিকার হয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী গত বছর পাড়ি জমান বাংলাদেশে। হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও গণধর্ষণের শিকার হয়ে কমপক্ষে ৭ লাখ রোহিঙ্গা নরনারী, শিশু, কিশোর পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হন। তারা কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে ভীষণ গাদাগাদি করে অবস্থান করছেন।
মিয়ানমারের সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত হয়ে যেসব নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন তাদের মধ্যে মেহের অন্যতম। তারই গর্ভে অনাকাঙ্খিত সন্তান ইয়াসমিনের জন্ম হয়েছে কিছুদিন আগে। মেহের জুনের প্রথম দিকে প্রথম তার প্রসব বেদনা বুঝতে পারেন। তিনি কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান নি। ছালা আর বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘরের কাঁচা মেঝেতেই তিনি একা একা প্রসব করেছেন ইয়াসমিনকে। তিনি বলেন, এই প্রসব বেদনা ছিল অসহনীয়। টানা পাঁচ ঘন্টা জীবনের সঙ্গে লড়াই করে তিনি প্রসব করেছেন ইয়াসমিনকে। মেহেরের আগে থেকেই দুটি সন্তান আছে। তাদের একজনের বয়স ৫ বছর। আরেকজনের ২।
কক্সবাজারে খাড়া পাহাড়ি ঢালে যে আশ্রয়শিবির গড়ে উঠেছে সেখানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। আছে পপকর্ন বিক্রেটা, মাছবিক্রেতা, সেলুন। ল্যাংটা ছেলেমেয়ে এখানে ওখানে কর্দমাক্ত মাটিতে খেলছে। এসব আশ্রয়শিবিরের প্রবেশ পথেই এনজিওগুলো স্থাপন করেছে ক্লিনিক। সেখানে গিয়ে নারীরা সন্তান প্রসব করতে পারেন। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ)-এর হিসাবমতে, ওই শরণার্থী শিবিরে এখন প্রায় ৩০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা নারী আছেন। প্রতি মাসে সেখানে জন্ম নিচ্ছে ৩ হাজার শিশু। এসব শিশুর কতজনের জন্ম ধর্ষণের ফলে তার প্রকৃত হিসাব কেউ বলতে পারেন না। তবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মার্চে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে দেখা যায় যৌন সহিংসতার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া কমপক্ষে ২৭০০ নারীকে মানবিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। এমএসএফ কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০১৭ সালের আগস্টের শেষ থেকে মে মাসের শেষ নাগাদ তারা ৪৪৩ জন ধর্ষিতার দেখা পেয়েছে। সঙ্কটের প্রথম ৫ মাসে ১০২জন ধর্ষিতাকে চিকিৎসা দিয়েছে আরেকটি এনজিও হোপ ফাউন্ডেশনের নেটওয়ার্ক ক্লিনিক। তারা বলেছে, এই সংখ্যা বরফ চাঁইয়ের একটি বিন্দুর মতো। ধারণা করা হয়, এমন ধর্ষিতা কয়েক হাজার আছেন। এমএসএফের ইতালিয়ান ধাত্রী জুলিয়া মেইস্ট্রেলি বলেন, মে মাসে আমরা সন্তান প্রসবের হার কিছুটা বাড়তে দেখেছি। তবে বেশির ভাগ সন্তান প্রসবের ঘটনা সনাক্ত করা যাচ্ছে না। এর কারণ, চার ভাগের তিন ভাগ নারীই তাদের সন্তান প্রসব করছেন নিজের আশ্রয়ে। যেসব নারী ক্লিনিকে সন্তান প্রসব করতে যাচ্ছেন সন্তান প্রসবের পরে তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কখনো তারা ওই সন্তানকে ফেলে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু যখন সন্তানের মুখ দেখেন তখন আর তাকে ফেলে যেতে পারেন না। তাকে সঙ্গে নিয়ে যান।
যে রাতে মেহেরকে ধর্ষণ করা হয় সে রাতে তিনি দুই সন্তান সহ একা ছিলেন বাড়িতে। তার স্বামী একজন কৃষক। তিনি তখনও মাঠে ছিলেন। ওই রাতে সেনাবাহিনীর পোশাক পরে অনেক মানুষ তাদের গ্রামে প্রবেশ করে এবং নারীদের একত্রিত করে। এরপর তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। একদিকে সাজানো বাড়িঘর জ্বলতে থাকে। অন্যদিকে এসব নারীকে তারা নিয়ে যায় বনের ভিতর। সেখানে কয়েক ঘন্টা আটকে রাখে তাদেরকে। এরই এক পর্যায়ে মেহের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ঘুম থেকে জেগেই তিনি দেখতে পান দু’জন সেনা সদস্য তার দুই সন্তানের মাথায় বন্দুক তাক করে রেখেছে। মেহের বলেন, ওই সেনা সদস্যরা তাদেরকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এ সময় আমি তাদের কাছে কাকুতি মিনটি করি। আমি তাদেরকে বলি তোমাদের যা খুশি আমার সঙ্গে করো তবু ওদের ছেড়ে দাও। এ সময় সেনারা আমার দিকে এগিয়ে আসে এবং আমাকে ধর্ষণ করে পালাক্রমে। সিএনএনের সঙ্গে নিজের ধর্ষিত হওয়ার কথা যেসব নারী সাহস দেখিয়ে স্বীকার করেছেন তাদের মধ্যে মেহের অন্যতম। এমনি আরেক নারী সেনুয়ারা (৩৫)। যখন তার ওপর হামলা চালানো হয় তখন তিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি বলেন, ৯ জন সেনা সদস্য জোর করে আমার বাড়িতে প্রবেশ করে। তারা আমার দেড় বছর বয়সী ছেলেকে গুলি করে। তারপর আমাকে রশি দিয়ে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। একজনের পর অন্যজন এভাবে তারা সবাই আমাকে ধর্ষণ করে। এ সময় তিনজন সেনা সদস্য তাদের বুঁট ও বন্দুক দিয়ে আমাকে প্রহার করতে থাকে। সকাল থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত এভাবে ওই সেনা সদস্যরা আমাকে ধর্ষণ করে। যখন তারা আমাকে ছেড়ে যায় তখন আমি ছিলাম ভীষণ দুর্বল। এমনকি আমার আঙ্গুলের সামনের অংশও নড়াচড়া করতে পারছিলাম না।
এরপর তার এক ভাই ও এক কাজিন তাকে তিন দিন ঝুলন্ত দোলনার মতো করে বহন করে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। এখানে আসার পর তিনি একটি সন্তান প্রসব করেছেন। বলেছেন, এখনও আমাকে ভীতি তাড়া করে ফেরে। গভীর রাতে যখন ঘুম ভেঙে যায় তখন দেখি আমার সারা শরীর ভয়ে ঘামছে।
মেহেরও তার দু’সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে কক্সবাজার এসেছেন। কিন্তু এখানে এসেই তার সব বিপদ কাটে নি। দু’মাস পরে তিনি বুঝতে পারেন ধর্ষিত হওয়ার ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন। মেহের বলেন, এটা বুঝতে পেরে একজন ওঝার কাছে গিয়েছিলাম। তার কাছে গর্ভপাতের ওষুধ চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে একটি বড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয় নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *