আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে এমন কিছু বিশ্বাস করার কোনোও কারণ নেই। নির্বাচনের আগে সরকার বিরোধী দলের কর্মীদের আটক করছে, মিডিয়া ও সুশীল সমাজের বাক্্রোধ করতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি থিংকট্যাংট যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস হিউম্যান রাইটস কমিশনে (টিএলএইচআরসি) ১৫ই নভেম্বর বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করে এ কথা বলেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিচালক জন সিফটন। ওয়াশিংটনে ২২০০ রেবার্ন হাউস অফিস ভবনে স্থানীয় সময় বিকাল আড়াইটায় ‘ইলেকশন অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ শীর্ষক’ অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন টিএলএইচআরসির সহ-সভাপতি র্যান্ডি হাল্টগ্রেন, এমসি এবং জেমস পি ম্যাকগোভার্ন এমসি। আলোচক প্যানেলে ছিলেন জন সিফটন, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক কমিশনের পলিসি বিশ্লেষক ওয়ারিস হুসেন, ওয়ার্ল্ডভিশন যুক্তরাষ্ট্রের চাইল্ড প্রটেকশন ও শিক্ষার সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার লরা ব্রামোন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ন্যাশনাল এন্ডোমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মোনা ডেভ। অনুষ্ঠান সম্পর্কিত বর্ণনায় টিএলএইচআরসি বলেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমান হারে মানবাধিকার জটিল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গার জন্য সীমান্ত খুলে দেয়ায় দেশটির ভূয়সী প্রশংসা করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে টার্গেট করছে বাংলাদেশ সরকার।রাজনৈতিক দলগুলোকে টার্গেট করছে বাংলাদেশ সরকার।
স্বাধীন মত প্রকাশের পক্ষে যারা তাদেরকেও হুমকি দেয়া হচ্ছে। এতে নাগরিক সমাজকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে উগ্রবাদ। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামান্য এক মাসের কিছু বেশি দূরে। এ সময় সারা দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অন্যান্য ব্যাপক অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে র্যাব সরকারের তথাকথিত মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চালিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। রয়টার্সের হিসাবে ২০১৮ সালের মে ও আগস্ট মাসে দুই শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার ও জোরপূর্বক গুম তো সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে মাঝে মাঝেই টার্গেট করা হচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধী, ব্লগার, সাংবাদিক ও অন্য মানবাধিকার কর্মীদের।
এর প্রেক্ষিতে, পর্যায়ক্রমিক সহিংসতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারী ও শিশুরা রয়েছে বিপন্ন অবস্থায়। এতে বলা হয়, নিয়মিত বৈষম্যের শিকার হন হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা। অবৈধভাবে জমি কেড়ে নেয়ার শিকারে পরিণত হন হিন্দুরা। তাদের মন্দির ও বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়া হয়। এর ফলে বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দুদের সংখ্যা কমে এসেছে। অনুষ্ঠানে আরো বলা হয়, যৌনতা সংশ্লিষ্ট পাচার, শিশু শ্রত ও বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর সুরক্ষা বিষয়ক কৌশল প্রয়োজন। বিশেষ করে যেখানে শতকরা ৫২ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের কম বয়সে। অনুষ্ঠানের শুরুতে বলা হয়, এমন জটিল পরিস্থিতিতে মানবাধিকার নিয়ে বিশ্লেষণ করবেন প্যানেলিস্টরা এবং তারা সুপারিশ করবেন যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যক্তিবিশেষের অধিকার, স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে বাংলাদেশকে উদ্বুদ্ধ করতে কি করা যেতে পারে। একই সঙ্গে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা নিশ্চিত করতে কি কি সুপারিশ করা যেতে পারে। ওই আলোচনা বা ব্রিফিং সংগ্রেস সদস্য, কংগ্রেশনাল স্টাফ, আগ্রহী জনগণ ও মিডিয়ার জন্য উন্মুক্ত ছিল।
অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য রাখেন ওয়ার্ল্ডভিশনের বাংলাদেশ বিষয়ক সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার লরা ব্রামন। বাংলাদেশে নির্বাচনীয় সহিংসতা সহ বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারকে শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের জন্য কংগ্রেসম্যান ম্যাকগভার্ন, কংগ্রেসম্যান হালটগ্রেন ও কমিশন সদস্যদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, গত বছর আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দিকে। রাখাইনে চরম সহিংসতার শিকার হয়ে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এসব রোহিঙ্গাদেরকে এখন যেভাবে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। রাখাইনে এখনও রোহিঙ্গারা তাদের জীবন ও নিরাপত্তা ভয়াবহ ঝুঁকিতে বলে মনে করে। এ অবস্থায় তাদেরকে অনিচ্ছায় ফেরত পাঠানো হবে শরণার্থীদের সুরক্ষা বিষয়ক মৌলিক নীতির লঙ্ঘন। ডিসেম্বরে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন। রাজনৈতিক সহিংসতা এখনও এখানে ভয়াবহ। পর্যায়ক্রমে তা শিশুদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে আসে। নির্বাচনী মৌসুমে এবং বিতর্কিত রাজনৈতিক ইভেন্টগুলোর বার্ষিকীগুলোতে শিশুরা যৌন সহিংসতা ও বোমার শিকার হয়ে থাকে। দুঃখজনক হলেও শিশুরা প্রতিদিনই এমন সহিংসতার ব্যাপক শিকারে পরিণত হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য উত্থাপন করেন নিরপক্ষে মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ফোর্সফিল্ড এনএফপি’র সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা ড. রিচার্ড এল বেনকিন। তিনি বলেন, আমরা কি বাংলাদেশের হিন্দুদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মকতার জটিলতার দিকে দৃষ্টি দেবো নাকি ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াবো এবং পদক্ষেপ নেবো? তিনি আরো বলেন, রংপুরের ঘটনা আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের হিন্দুরা কত আতঙ্কের মধ্যে থাকেন এবং তারা বর্তমান অথবা অন্য কোনো সরকারের কাছ থেকে সুবিচার আশা করেন না। তার ভাষায়, বর্তমান সরকারের কিছু সদস্য আমাকে বলেছেন, আমাদেরকে সময় দিন এবং নির্বাচনের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তারপরই হিন্দুদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিরুদ্ধে দৃষ্টি দেয়া হবে। কিন্তু আমার এই অপেক্ষা করার অর্থ হতে পারে কিছুই না। এই সরকার বোঝে যে এটা শুধুই একটি রাজনৈতিক বিষয়। তিনি প্রশ্ন রাখেন, আবার জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। এ সময়ে এ বছরে হিন্দুদেরকে একই পরিণতি থেকে সুরক্ষিত রাখতে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশী কর্মকর্তারা এমন নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে যে, সহিংসতা বন্ধে সব কিছু করা হবে। তবে ‘হিন্দুরা আমাকে বলেছেন তারা আগেও একই রকম কথা শুনেছেন এবং এ বছরও তার কোনো ব্যত্যয় তারা দেখতে পান নি’।
ওয়ারিস হুসেন তার বক্তব্যে বলেন, ২০১৯ সালের শুরুতে নতুন যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তাদেরকে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। ইসলামপন্থি গ্রুপ হেফাজতে ইসলাম ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননার মামলায় শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান করার দাবি তুলেছিল। কিন্তু সেই ২০১৩ সালে শেখ হাসিনার সরকার তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। এমন দাবির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছিল হাসিনার সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। উপরন্তু সেই হেফাজতে ইসলাম সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মাননা দিয়েছে। তিনি মাদরাসা ডিগ্রিকে মাস্টার্স সমমূল্যায়নের স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার এ নীতির জন্য তাকে সম্মাননা দিয়েছে হেফাজত। কিছু সমালোচক বিষয়টিকে দেখছেন এভাবে যে, হেফাজতের ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিতির মানে হলো জনগণের রক্ষণশীল অংশের নির্বাচনী সমর্থন পাওয়া।