বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলটির অন্যান্য নেতার মনোনয়নপত্র বাতিল সরকারের দানবীয় আচরণ এবং এটি তাদের নিখুঁত মাস্টার প্ল্যানের অংশ বলে মন্তব্য করেছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, মনোনয়নপত্র বাতিলের মধ্যদিয়ে সরকারের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, দূরভিসন্ধিমূলক। গতকাল দুপুরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। রিজভী বলেন, নির্বাচন বানচালের জন্য সরকার দেশব্যাপী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ক্ষমতার মৌতাতে বুঁদ হয়ে থাকার জন্যই অবৈধ শাসকগোষ্ঠী আসন্ন নির্বাচন নিয়ে মাস্টার প্ল্যানে ব্যস্ত আছে। তফসিল ঘোষণার শুরু থেকেই নির্বাচনের পরিবেশ যেন আরো অবনতি হয়েছে। নৌকার পক্ষে হালে পানি না পাওয়ায় বিএনপিসহ বিরোধী দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ও নেতাকর্মীদের শুধুমাত্র মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার করেই সরকারের সাধ মিটছে না।
এখন তাদের ভিটেমাটিতে ঘুঘু চরিয়ে দিতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।
সারা দেশে প্রার্থীসহ বেছে বেছে বিএনপির সক্রিয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে। প্রার্থীসহ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। আর এসব কিছু নেপথ্য থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে দুটি শক্তিশালী কেন্দ্র। একটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অন্যটি গণভবন। নির্বাচন কমিশন শুধু ওই দুই কেন্দ্রের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। দেশে বিরোধী দলশূন্য নির্বাচনী মাঠ তৈরি করতেই এসব ঘৃণ্য অপকর্ম সাধন করা হচ্ছে। যেভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে, গুম করছে, গ্রেপ্তারের পর অস্বীকার করছে, রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে এবং জামিনে মুক্তিলাভের পরও জেলগেট থেকে শ্যোন অ্যারেস্ট করা হচ্ছে। তাতে সারা দেশে এক রক্ত-শীতল করা আতঙ্কজনক পরিবেশ বিরাজমান রয়েছে।
জনগণকে ভোট থেকে দূরে রাখার জন্য তারা পরিকল্পিতভাবে ভোটের পরিবেশ বিনষ্ট করার পাঁয়তারা করছে। পুলিশসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সরকারি দলের অনাচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ঘটনা থেকেই মনে হয়, তারা ভোটারদের ভীতিগ্রস্ত করতে চায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাচনের সময় এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি কখনো দেখা যায়নি। সুপরিকল্পিত মাস্টার প্ল্যানের অংশ হিসেবেই এসব করা হচ্ছে নৌকাকে জালিয়াতির মাধ্যমে বিজয়ী করার জন্য। নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে রিজভী আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশন হয় অন্ধ, না হয় কানা। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কতিপয় কমিশনার সরকারের পক্ষে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন, আইন-আদালত, বিচারিক প্রক্রিয়া সবকিছুর ওপরই সরকার যেন সিন্দাবাদের জিনের মতো সওয়ার হয়ে আছে।
দেশের বিভিন্ন জেলায় রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে মনোনয়নপত্রের দুই পাশ থেকে ধরে আছেন পুলিশের দুইজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। অর্থাৎ পুলিশ কর্মকর্তারা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে। অথচ এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন উদাস কবির মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য কোনো ব্যবস্থা নিলো না। তিনি আরো বলেন, তফসিল ঘোষণার পর গাজীপুরের ওসি আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে পোশাক পরে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তিনি সেখানে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশন এক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে কারো জানা নেই। অথচ সময়ের অজুহাত তুলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের মনোনয়নপত্র জমা নেয়া হয়নি।
রিজভী বলেন, মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অধ্যাপক গোলাম রাব্বানীর পক্ষে রাকিবুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে তাকে পুরনো একটি মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। অথচ কিছু রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের পক্ষপাতযুক্ত বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এই পক্ষপাতের ধারা ভোটগ্রহণের দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। সুতরাং কমিশন নিজেরাই নিজেদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ওসি ও এসপি পর্যায়ের কর্মকর্তারা এখনই যেভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিচ্ছে তাতে নির্বাচনের দিনে কি পরিস্থিতি হবে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। এত নিয়মভঙ্গের পরেও নির্বাচন কমিশনের চোখ বন্ধ রাখাটা আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে কমিশনের ভূমিকা সারাবিশ্বে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লিখিত হবে।
তিনি বলেন, শনিবার সন্ধ্যার পর বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি মীর সরফত আলী সপু এবং বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম পটুকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যুবদল গাজীপুর মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন বাটকে শুক্রবার বিকালে গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু তার আটকের বিষয়টি অস্বীকার করছে তারা। সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজ নেয়া হলেও তার এখনো কোনো সন্ধান মেলেনি।
তিনি বলেন, শনিবার বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর নাটোরের বাসভবনে ৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির নির্বাচনী মতবিনিময় সভা চলাকালে হঠাৎ করে জয়বাংলা স্লোগান দিতে দিতে আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সভার ওপর হামলা চালায় এবং রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বাসভবনে ব্যাপক ভাঙচুর ও কয়েকটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় আমি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি, ধিক্কার জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও সমুচিত শাস্তির দাবি করছি। ফেনীর সদর উপজেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন বাচ্চুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ফেনী-২ নির্বাচনী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের ফেনীর বাসায় প্রবেশ ও বেরুনোর সময় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে, পুলিশ নেতাকর্মীদেরকে গ্রেপ্তারের জন্য হানা দিচ্ছে, তাণ্ডব চালাচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করলেও প্রশাসন নির্বিকার রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম, সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, বেলাল আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।