দল হয়।’ নাইকো মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানিতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ শুনানিতে বলেছিলেন, বলতে কষ্ট হয়, আমরা বিরোধী দলে থাকায় এ মামলার বিচার শুরু হচ্ছে। এ সময় পাশে থাকা কয়েকজন আইনজীবী বলেন, বিএনপি বিরোধী দলেও নেই। তাদের এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে এজলাসে বসা বিএনপি চেয়ারপারসন এ মন্তব্য করেন। গতকাল পুরনো ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে অবস্থিত পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারের অস্থায়ী বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ হাফিজুর রহমানের আদালতে নাইকো মামলার অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি চলছিল। পরে এ মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২১শে জানুয়ারি দিন ধার্য করেছেন আদালত। এর আগে গত ৩রা জানুয়ারি এ মামলার শুনানি হয়।
শুনানি শেষে দুপুর ১টা ৫৩ মিনিটে খালেদা জিয়াকে হুইল চেয়ারে করে আবার কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ ও কারা রক্ষীরা। এর আগে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে তাকে আদালতে হাজির করা হলে শুনানি শুরু হয়।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুনানিতে ছিলেন। আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন, সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, আইনজীবী মো. আক্তারুজ্জামান প্রমুখ।
শুনানির শুরুতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ থাকা আলামতের অনুলিপি চেয়ে বলেন, আলামতের নথি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এগুলো ছাড়া শুনানিতে বক্তব্য রাখবো কীভাবে? দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল জবাবে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ নথিপত্র দিতে বাধ্য। কিন্তু আসামিপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী দেয়া যাবে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৪ অনুযায়ী ভুলবশত কারারুদ্ধ হলে দেয়ার বিধান রয়েছে। তার পরেও অভিযোগপত্রে যে আলামতের নাম রয়েছে সেগুলো আসামিপক্ষ পাবেন।
আদালত বলেন, যে নথির অনুলিপি চেয়েছেন সে বিষয়ে আপনার মত কী? জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, সত্যায়িত অনুলিপি নিতে পারবেন। কিন্তু উনারা বারবার মামলা কার্যক্রম বিলম্বিত করেছেন।
জবাবে আসামিপক্ষের আইনজীবী বোরহানউদ্দিন বলেন, আমাদের প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে গিয়েছি। এখনো পর্যন্ত আমাদের আরজি সেখানে নাকচ হয়নি।
আদালত বলেন, যথা শিগগির আপনাদের আলামতের নথি দেয়া হবে। আপনারা এগুলো পাবেন। আপনারা বিধি অনুসারে আবেদন করুন।
মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি এ মামলার সপ্তম বিচারক। উনারা শুনানি বিলম্বিত করতে নথি চাইছেন। মামলা এখন অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। মামলার নথি বিশাল আকারের। আমরা কোনটি ব্যবহার করবো কোনটি করবো না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
এরপর আদালত শুনানি শুরু করতে বললে বেলা ১২টা ৫৫ মিনিটে মওদুদ আহমেদ অভিযোগপত্র পড়া শুরু করেন। তিনি বলেন, আমি প্রাসঙ্গিক অংশ পড়তে চাই। অভিযোগ থেকে পড়ে তিনি বলেন, ২০০১ সালের ১১ই জুন নাইকোকে গ্যাসক্ষেত্রের কাজ দেয়া হয়েছে। এটা ছিল একটি চলমান প্রক্রিয়া। আগের আওয়ামী লীগ সরকারের করা চুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে পরবর্তী সরকার। আগের সরকারের চুক্তির জন্য মামলা করা হলে কোনো সরকার চলতে পারবে না।
তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে কোনোভাবে চুক্তির জন্য দায়ী করা যায় না। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একবার চুক্তি ফেরত পাঠিয়েছিলেন। চুক্তি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। তিনি যে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে চেয়েছেন এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। নাইকো যদি অদক্ষও হয় সেটার জন্য দায়ী আগের আওয়ামী লীগ সরকার। এর জন্য খালেদা জিয়া দায়ী হবেন কেন?
মওদুদ আহমেদ বলেন, চারদলীয় জোট সরকার আগের সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন মাত্র। এটা চলমান প্রক্রিয়া থেকে করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রথা হলো আগের সরকার যেটা করবে সেটা পরবর্তী সরকারও রক্ষা করবে। ক্ষমতায় কোনো দল ছিল, সেটা মুখ্য নয়। যখন যে সরকার থাকবে, তারা চুক্তির সুরক্ষা দেবে।
১৯৯৮ সালের ২৮শে জুন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব তৌফিক ইলাহী নাইকোর সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার সুপারিশ করেন। এ সময় একটু হেসে মওদুদ বলেন, তিনি আমার ভায়রা। এ পর্যায়ে দুদকের আইনজীবী বলেন, আপনার আনন্দের জন্য আমরা আনন্দিত।
মওদুদ আহমেদ বলেন, নাইকো চুক্তির আগে ফ্রেমওয়ার্ক অন আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছিল। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর অধীনে চুক্তি হয়েছিল। ফ্রেমওয়ার্ক অন আন্ডারস্ট্যান্ডিং করেছিল পূর্ববতী আওয়ামী লীগ সরকার।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে চুক্তির ক্ষেত্রে অবৈধভাবে গ্রহণের (আনসলিসিট অফার) চিত্র পাওয়া যায়। এটা পূর্ববর্তী সরকারের জন্য প্রযোজ্য হবে। কারণ, তারা ২৩টি ব্লকের ৯ ও ১০ নম্বর ব্লকের দরপত্র আহ্বান করে। এর আগে নাইকো ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে কয়েকবার আবেদন করেও ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ২৬শে জুন মন্ত্রিসভায় প্রান্তিক গ্যাস ক্ষেত্রের উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার।
মওদুদ আহমদ বলেন, বলতে কষ্ট হয় আমরা বিরোধী দলে আছি বলে মামলাটি চলছে। বিএনপি সমর্থক কয়েকজন আইনজীবী বলেন, এখন তো বিরোধী দলেও নেই। তখন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘সংসদের বাইরে থেকেও জনগণের পক্ষে থাকলে বিরোধী দল হয়।’
মওদুদ আহমেদ বলেন, এ পর্যন্ত পড়ে মনে হচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধে নয়, যারা আগের সরকারে ছিল তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগপত্র।
এ পর্যায়ে মওদুদ আহমদ উচ্চ আদালতে ৩৬৫ জনের আগাম জামিন আবেদনের শুনানি করতে হবে জানিয়ে সময় চাইলে আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করেন।
আদালত গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের পক্ষে শুনানি করতে বললে আইনজীবী মো. জাহেদুল ইসলাম (কোয়েল) বলেন, আগের অভিযোগপত্রে আমার মক্কেলের নাম ছিল না। শুধু একজন আসামির জবানবন্দির ভিত্তিতে তাকে আসামি করা হয়েছে। আমার মক্কেলের আসামি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তিনি সরকারের কেউ না। তার পরিচয় একজন ব্যবসায়ী।
এরপর জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সি এম ইউসুফ হোসাইন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের পক্ষে বলেন, আমি এক বছর মন্ত্রণালয়ে ছিলাম। পরে পদোন্নতি পেয়ে অন্যত্র বদলি হই। একজন সিনিয়র সহকারী সচিবের এত বড় চুক্তিতে ভূমিকার রাখার সুযোগ কোথায়? আমার ওপরে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব ছিলেন। তাদের অনেকে পরের বিএনপি সরকার, জরুরি অবস্থার সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দায়িত্ব পালন করে সচিব হয়ে অবসরে গেছেন।
তিনি বলেন, এ মামলা ভুয়া। মামলার কারণে আমার অবসর ভাতা আটকে গেছে। স্ত্রী ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাতে পারছি না। আমাকে অব্যাহতি দেয়া হোক।
জরুরি আমলের সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৯ই ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে গ্যাসচুক্তি করায় রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতির অভিযোগে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০০৮ সালের ৫ই মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়।