গত রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকায় জাতিসংঘ দপ্তর যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ ও মানবাধিকার’ শীর্ষক যে সেমিনারের আয়োজন করেছে, নানা কারণেই তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সেমিনার এমন সময়ে আয়োজন করা হয়েছে, যখন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অনেক বিদেশি সংস্থা ও সংগঠন সমালোচনামুখর। এ সময়ে মানবাধিকার বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। কেননা মানবাধিকারের বিষয়ে আমাদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত যত ফারাকই থাকুক না কেন, এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা কোনোভাবে অগ্রাহ্য করতে পারি না।
এই সেমিনারে মানবাধিকার নিয়ে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পোসহ অন্যান্য বক্তার সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যের পার্থক্য বেশ স্পষ্ট। অন্য বক্তারা মতপ্রকাশ ও নাগরিক অধিকারকে মানবাধিকারের পূর্বশর্ত হিসেবে অভিহিত করলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই প্রধান মাপকাঠি বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে আমরা জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ও বাংলাদেশের সংবিধানের বাইরে যেতে পারি না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের মানবাধিকারের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন এবং এর পক্ষে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদাহরণ টেনেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি মানবাধিকারের একমাত্র মাপকাঠি হতো, তাহলে চীন বা মালয়েশিয়ার মানবাধিকার নিয়ে এত কথা উঠত না। মানবাধিকারের সঙ্গে অবশ্যই নাগরিকের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের বিষয়টি যুক্ত। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল’ ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।’ এই অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার দেওয়ার কথাও বলা আছে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এমন আইন করতে পারে না, যা এই স্বাধীনতার পরিপন্থী।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি কেউ অস্বীকার করছে না। তবে সেই উন্নয়নের সুবিধা সব নাগরিক পাচ্ছেন কি না, তা–ও ভেবে দেখার বিষয়। একদিকে বাংলাদেশে দ্রুত ধনী হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে বিশ্বের অধিক দরিদ্র মানুষ যে পাঁচটি দেশে বসবাস করছে, সেই তালিকায়ও আছে। অতএব, উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে যেমন বৈষম্য দূর করতে হবে, তেমনি নাগরিক স্বাধীনতার বিষয়টিও নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
সেমিনারে নাগরিক অধিকারের অন্তরায় হিসেবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জাহালমের মতো নিরপরাধ মানুষের জেল খাটা, ধর্ষণের আসামির ‘হারকিউলিস’ হওয়ার প্রবণতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধার কথাও আলোচনায় এসেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যানসহ অনেকেই এসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এড়িয়ে গেছেন। তিনি মানবাধিকার সম্পর্কে অনেকের ধারণা ‘দুর্বল’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, সেটি নাগরিকের মানবাধিকার উপেক্ষা করার শামিল। অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোনোভাবে নাগরিক স্বাধীনতার বিকল্প হতে পারে না।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে শুধু মানুষের আহার-বাসস্থানের কথা নেই, ধর্ম, বর্ণ জাতি ও নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথাও আছে। মানবাধিকার প্রশ্নে জাতিসংঘ প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতার ওপর জোর দিয়েছেন, যা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্যের সমার্থক নয়। জাতিসংঘ সনদের প্রতি আমাদের যে অঙ্গীকার আছে, সেটি প্রতিপালনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ হতে পারে সত্যিকার মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
সবাইকে মনে রাখতে হবে যে সেমিনারে, সভায় বক্তৃতা দিলেই নাগরিক বা মানবাধিকার নিশ্চিত হয় না। নাগরিক অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে, সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের নামের আগে ‘স্বাধীন’ শব্দবন্ধও পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারবে না, যদি না সংশ্লিষ্টদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়।