ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে গত মাসের শেষে দ্বিতীয়বারের মতো মুখোমুখি বসেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। উত্তেজনাপূর্ণ দুই দেশের সরকার প্রধানের এই আলোচনা দু’দিন দীর্ঘায়িত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই আলোচনার টেবিল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ডনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং উন। সংবাদ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতার তোয়াক্কা না করে হ্যানয় ছাড়েন তারা। বৈঠকের আগে দুই নেতা ব্যতিক্রম বিশ্ব উপহার দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। হ্যানয়ের মেট্রোপোল হোটেলে পরস্পরকে হাসিমুখে স্বাগত জানান তারা। চিরবৈরী দুই দেশের সরকার প্রধানকে একই টেবিলে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় দেখে আশাবাদী হয়ে ওঠে বিশ্ববাসী। তাদের আশা, শত্রুভাবাপন্ন দুই নেতার এমন আন্তরিকতাপূর্ণ সাক্ষাৎ হয়তো বিশ্বে পারমাণবিক ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমিয়ে আনবে। কিন্তু উভয় পক্ষের একগুঁয়েমি ও ছাড় না দেয়ার মানসিকতার কারণে হতাশ হয়েছেন বিশ্ববাসী।উত্তর কোরিয়ার কাছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধের নিশ্চয়তা দাবি করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। বিপরীতে উত্তর কোরিয়া তাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আকুতি জানায়। দুই নেতার আলোচনায় এগুলোই নির্ধারণী ভূমিকা পালন করে।
বৃহস্পতিবার বিকালে ডনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে এয়ার ফোর্স ওয়ান হ্যানয় ছেড়ে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর পর নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট দফায় দফায় বক্তব্য দিতে থাকেন যে, পিয়ংইয়ং তাদের ওপর আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি চেয়েছে। কিন্তু ওই দিনই রাতে উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে তাদের দাবি স্পষ্ট করেন। সেখানে তিনি পরিষ্কার উল্লেখ করেন, উত্তর কোরিয়া নিষেধাজ্ঞা থেকে শুধু আংশিক মুক্তি চেয়েছে। এর বিনিময়ে ইয়ংবিয়নে নিজেদের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করার বাস্তবসম্মত প্রস্তাবও দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। কিন্তু ট্রাম্প সাংবাদিকদের জানান, ‘তারা চেয়েছিল, তাদের ওপর আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হোক। কিন্তু আমরা এটা করতে পারি না। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে আগ্রহী। কিন্তু এর জন্য আমরা সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারি না।’ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেয়া দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যের ফলে হ্যানয় সামিট কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের বিষয়ে নিজেদের এমন সুস্পষ্ট অবস্থান আগে কখনো প্রকাশ করেনি। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী রি ইয়ং হো জানিয়েছেন, দু’দেশের বর্তমান আস্থার জায়গা থেকে এটাই ছিল তাদের নেয়া সবচেয়ে বড় নিরস্ত্রীকরণ পদক্ষেপ। তিনি বলেন, নিরস্ত্রীকরণের পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম, আমরা সামরিক পদক্ষেপ নিলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরো বেশি বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ কারণেই আমরা আংশিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবিকে উপযুক্ত বলে মনে করেছি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এর বিপরীতে আমাদের থেকে ইয়ংবিয়ন পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের পাশাপাশি আরো পদক্ষেপ দাবি করে। উত্তর কোরিয়া এতে রাজি হয়নি। এদিকে, হোয়াইট হাউজ দাবি করেছে দু’দেশের মধ্যে সংলাপ চলবে। ট্রাম্প বলেন, তারা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বৈঠক ছেড়ে এসেছেন, পরস্পরের সঙ্গে করমর্দনও করেছেন।
যা হোক, হ্যানয় সামিট থেকে দৃশ্যত খালি হাতে ফিরেছেন ডনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং উন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এত দীর্ঘ সময়ের সাক্ষাতেও শুধুমাত্র ছাড় না দেয়ার মানসিকতার কারণে মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারা দুই নেতার চরম ব্যর্থতা। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক কূটনীতিক লামি কিম বলেন, সাধারণত এ ধরনের ঘটনা এড়াতে অনেক চুক্তি মুখোমুখি বৈঠকের আগেই করে রাখা হয়। কোনো চুক্তি না করে বৈঠকের মধ্যপথে ঘরে ফেরার কারণে ট্রাম্প ঘরে-বাইরে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছেন। কিম জং উনের জন্যও এটা ইতিবাচক না। উত্তর কোরিয়ার গণমাধ্যম হ্যানয় সামিটের খবর ফলাও করে প্রচার করেছে। দেশটির অধিবাসীরা অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিষয়ে আশাবাদী। সামিট ব্যর্থ হওয়ার পর এখন পরিস্থিতি কোন্ দিকে মোড় নেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।