নানা নাটকীয়তার পর দলীয় ও জোটগত সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে এমপি হিসেবে শপথ নিয়েছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। তার এই শপথ গ্রহণে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। বিশেষ করে তার নির্বাচনী এলাকার মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও হতাশা। তবে উন্নয়নের স্বার্থে তার এই শপথ গ্রহণের যৌক্তিকতাও দেখছেন অনেকেই। তার শপথগ্রহণকে বিএনপি নেতিবাচকভাবে দেখলেও সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে রয়েছে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত। ডাকসুর সাবেক এই ভিপি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসনে ছিলেন গণফোরাম মনোনীত ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী। সে নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের বিজয়ী ৮ প্রার্থীর একজন তিনি। কিন্তু নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান ও ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিতরা শপথ নেবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্ল্যাটফর্ম।কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে গতকাল স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে শপথ নেন তিনি। শপথ নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে বহিষ্কার করে গণফোরাম। অন্যদিকে অঙ্গীকার ভঙ্গ ও রাজনৈতিক ছলনা বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি।
সুলতান মনসুরের শপথ নিয়ে নানা মতামত প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জহুর লাল দত্ত বলেন, সুলতান মনসুর বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা। দেশে আওয়ামী লীগের যে প্রচলিত রাজনীতি তিনি তার সংস্কার চেয়েছিলেন। কিন্তু শপথ নিয়ে তিনি বিচক্ষণতার জায়গায় থাকতে পারেননি। তিনিও ক্ষমতার অংশীদার হতে চান। সুলতান মনসুর মুখে যা বলেন, কাজে তা ফলে না- এটাই এখন পরিষ্কার হলো। উদীচী কুলাউড়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্মাল্য মিত্র সুমন বলেন, ঐক্যফ্রন্টের অন্যপ্রার্থীরা শপথ না নিলেও ব্যক্তিগতভাবে শপথ নেয়ার অধিকার আছে সুলতান মনসুরের। সময়ের সাহসী সন্তান তিনিই, যিনি ভোটারের মন বুঝেন। উন্নয়নের স্বার্থে তাঁর শপথকে স্বাগত জানাই।
এ ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মুক্তাদির তোফায়েল বলেন, সুলতান মনসুর বলেছিলেন- শেখ হাসিনার অধীনে এটি প্রহসনের নির্বাচন। কিন্তু শপথ নেয়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন একাদশ জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই হয়েছে। এটাকে আমরা ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনোটাই মনে করছি না। স্থানীয় গাড়িচালক ইসহাক মিয়া বলেন, উন্নয়নের জন্য এমপি দরকার, কাজেই উনার শপথ নেয়া প্রয়োজন। কৃষক মজিদ মিয়া ও কুলাউড়া দক্ষিণবাজারের ব্যবসায়ী সোয়েব আহমদ সোহাগ বলেন, এত কিছু বুঝি না দলমত নির্বিশেষে উনাকে ভোট দিয়েছি। তিনি শপথ নিয়েছেন। আমরা আশাবাদী তিনি আমাদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন।
এদিকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম ক্ষোভ ও হতাশা। বিএনপির প্রবাসী নেতৃবৃন্দও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা মন্তব্য করে সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রেদওয়ান খান বলেন, আমরা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবো না। শপথ নেয়া উনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। অন্যদিকে উপজেলা বিএনপির অপরাংশের সাধারণ সম্পাদক এমএ মজিদ বলেন, ঐক্যপ্রক্রিয়ার শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন সুলতান মনসুর। তার উচিত ছিল নির্বাচন পূর্ববর্তী সেই আদর্শ ধরে রাখা। কিন্তু তিনি গণতন্ত্রের মা খালেদা জিয়ার মুক্তি ও জাতীয় স্বার্থে ভূমিকা রাখার বদলে ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নিয়েছেন।
এর মাধ্যমে তিনি আদর্শ বিচ্যুত হয়েছেন। উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র কামালউদ্দিন আহমদ জুনেদ বলেন, আমরা মাঠ পর্যায়ের মানুষ। সুলতান মনসুরের বিষয়ে কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত নেবে তা সমর্থন করবো। তিনি যদি সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শপথ নেন, তাহলে সে দায় কুলাউড়া বিএনপি নেবে না। কুলাউড়া উপজেলা বিএনপির অপরাংশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও পৌর প্যানেল মেয়র জয়নাল আবেদীন বাচ্চু বলেন, আওয়ামী লীগ তাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল, আমরা সেখান থেকে তুলে এনেছি। জেল, জুলুম মাথায় নিয়ে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলাম।
কিন্তু তিনি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নেয়ায় মানুষের মন থেকে চলে গেছেন। জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা বলেন, সুলতান মনসুর বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বেঈমানী করেছেন। কুলাউড়া বিএনপি তাঁর গণবিরোধী পদক্ষেপকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে। তাঁর এই অপতৎপরতার তীব্র নিন্দা জানাই।
এদিকে আরব আমিরাতের আল ইয়াহার বিএনপির সভাপতি রায়হানুল ইসলাম শামীম তার ফেসবুক স্টাটাসে লিখেছেন- ‘এগুলি হলো (আমাদের) বিএনপির ভুলের ফসল। যারা বিএনপিকে কুলাউড়ায় প্রতিষ্ঠিত ও শক্ত করেছিলেন উনাদের অভিশাপের ফসল।’ সাবেক ছাত্রনেতা ও বিএনপির প্রবাসী নেতা নিজামুর রহমান টিপু তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে লিখেছেন- ‘মাননীয় স্পিকার, আমরা কি উনার নামের সঙ্গে জাতীয় বেঈমান ও আন্তর্জাতিক মীর জাফর বিশেষণ যোগ করতে পারি..?’