উপমহাদেশের সেরা ক্রিকেট লড়াই কোনটি? অবশ্যই ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ। অনেকে বলতে পারেন, সে তো টিকে আছে কাগজে-কলমে। আইসিসির ইভেন্ট ছাড়া গত অর্ধযুগে দুই প্রতিবেশী মুখোমুখি হলো কোথায়? তাদের দ্বৈরথ-সূর্য বরং অস্তগামী আর দিকচক্রবালে উঁকি দিচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত দ্বৈরথ।
দ্বিপক্ষীয় সিরিজে ভারত-পাকিস্তান সবশেষ মুখোমুখি হয়েছে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে। রাজনৈতিক জটিলতায় এরপর আর কেউ কারও মাটিতে পা রাখেনি। এ সময়ে আইসিসির ইভেন্ট আর এশিয়া কাপ ছাড়া মুখোমুখি হয়নি দুই প্রতিবেশী। আর এই অচলায়তনের মধ্যে ভারতের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঁকি দিয়েছে বাংলাদেশ। কথাটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ভালো করে মনে করে দেখুন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারত-বাংলাদেশ লড়াইয়ের উত্তাপে ভোগেন দুই দেশেরই ক্রিকেটপ্রেমী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। উৎসবের নয়, বাগযুদ্ধের।
আরেকটি ভারত-বাংলাদেশ লড়াই সামনে। বার্মিংহামে মঙ্গলবার ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটা বাংলাদেশের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সেমিফাইনালে ওঠার আশা টিকিয়ে রাখতে জয়ের বিকল্প নেই। এমন চাপের মুহূর্তে দুই দলের সাম্প্রতিক মুখোমুখি হওয়ার পরিসংখ্যান দেখলে আক্ষেপ বাড়বে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর কেটে যাচ্ছে চার বছর। এ সময়ে ভারত-বাংলাদেশ খেলেছে মাত্র ৬টি ওয়ানডে! অর্থাৎ, চার বছরে গড়ে মাত্র দেড়টি করে ম্যাচ। বাংলাদেশ মাঠের লড়াইয়ে ধীরে ধীরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমিয়ে তুললেও অন্তত সাম্প্রতিক ম্যাচসংখ্যায় দ্বৈরথ বলার উপায় নেই। তাতে ক্ষতিটা হচ্ছে কার? অবশ্যই ক্রিকেটের।
তা নয় তো কী? শ্রীলঙ্কা এখন ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। আর পাকিস্তান? আজ ভালো তো কাল কী ঘটবে বলা যায় না। বিশ্বকাপেও ভারতের কাছে পাত্তাই পাচ্ছে না দলটি। ওয়ানডেতে এ উপমহাদেশের দলগুলোর মধ্যে ভারতের চোখে চোখ রেখে লড়াই করা সামর্থ্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। দুটি দেশের ক্রিকেট বাজারই লাভের গুড়ে ভর্তি। এপার কিংবা ওপার—যে মাটিতেই ম্যাচ খেলান না কেন, গ্যালারিতে তিল ঠাঁই থাকে না! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব চলে। ক্রিকেটের এই রমরমা বাজারটুকু কেউ বোঝে না? অবশ্যই বোঝে, কিন্তু ঠিক কী কারণে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ এত কম মাঠে গড়াচ্ছে, সেটি ক্রিকেটের ‘রক্ষক’ সম্প্রদায় ছাড়া আর কে বলতে পারে!
গত বিশ্বকাপের পর মাত্র একবারই বাংলাদেশ সফরে এসেছিল ভারত। সেটি ওই ২০১৫ সালেই। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে হেরে দেশে ফিরেছিল ভারতীয় দল। এরপর ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ যে তিনটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে, তা আইসিসি ও এসিসির কল্যাণে। মানে, আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আর এশিয়া কাপ—যা আয়োজন করে থাকে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি)। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে ভারতের কাছে হেরেছে বাংলাদেশ। আর গত বছর দুবাইয়ে এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ও শেষ ম্যাচটা (ফাইনাল) খেলার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। লক্ষণীয় বিষয়, ২০১৬ সালে কিন্তু দুই দলের কোনো ম্যাচ দেখা যায়নি।
ক্রিকেটের অন্তত সংক্ষিপ্ত সংস্করণে বাংলাদেশ এখন উপমহাদেশের ক্রিকেটশক্তি। একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। এশিয়া কাপ এ মহাদেশের শ্রেষ্ঠত্বের টুর্নামেন্ট। গত সাত বছরে চারবার মাঠে গড়িয়েছে এ টুর্নামেন্ট—যেখানে তিনবার ফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ। ভারত-পাকিস্তান দুবার করে, শ্রীলঙ্কা একবার। শেষ পর্যন্ত হয়তো শিরোপা জিততে পারেনি, কিন্তু মন জিতে নেওয়ার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকেনি। সবশেষ ফাইনালে ভারতের শ্বাসরুদ্ধকর জয়ের পর স্বয়ং ভারতের সাবেক ক্রিকেটার থেকে সমর্থকেরা প্রশংসা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ দলকে। আর সেটাই প্রথমবার ছিল না।
বাংলাদেশ ওয়ানডে মর্যাদা পাওয়ার ১৪ বছর আগে বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। অর্থাৎ, বেশ আগে থেকেই তারা ক্রিকেটের পরাশক্তিগুলোর একটি। এমন একটি দলের বিপক্ষে প্রথম হামাগুড়ি তারপর উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমিয়ে তুলেছে বাংলাদেশ। সেটিও এমন সময়ে, যখন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের আগুন প্রায় নেভার পথে। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিদায় নিশ্চিত হওয়া সেই হার থেকে হিসাব করলে এই এক যুগে দুটি দলের লড়াইয়ে বিতর্ক কিংবা মুখরোচক অনেক গল্প-ঘটনাই আছে।
২০১৫ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ‘নো বল’ বিতর্ক, মাহমুদউল্লাহর আউট, মওকা মওকা বিজ্ঞাপন, ওয়ানডে সিরিজে মোস্তাফিজকে ধোনির ধাক্কা, বাংলাদেশকে শেবাগের ‘অর্ডিনারি’ বলা কিংবা ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে জয়ের আগেই মুশফিকের অকালপক্ব উদ্যাপন—দ্বৈরথ বলার মতো বেশ ভালো ভালো উপকরণ মজুত আছে দুই দলের অতীত মুখোমুখির ইতিহাসে। সত্যি বলতে, ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের জায়গাটা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ লড়াই—কিন্তু এ লড়াইকে এখনো দ্বৈরথ বলার সময় আসেনি। বলা ভালো, দ্বৈরথ বলতে দেওয়া হচ্ছে না। সেই দায়টুকু দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ডের ওপরই বর্তায়। নিয়মিত মুখোমুখি না হলে কী আর দ্বৈরথ বলা যায়?
দুটি দেশের সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের হতাশাটুকু তাই থেকেই যায়—মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, ‘নিয়মিত’ কেন পাই না!